নোবেলজয়ী অধ্যাপক স্যর রজার পেনরোজ়।
নোবেলজয়ী অধ্যাপক স্যর রজার পেনরোজ় বড় কাছের মানুষ। এত বড় মাপের বিজ্ঞানী, কিন্তু এমন সরল, ভদ্র, নম্র মানুষ কমই দেখা যায়। অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই। বিগত ২৫ বছর ধরে কলকাতায় তাঁর আনাগোনা, এখানকার মানুষের সঙ্গে প্রাণের টান।
আইনস্টাইনের ‘জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’র অলিগলিতে কত বিশ্বজাগতিক তথ্য লুকিয়ে আছে, তা রজারের নখদর্পণে। দেখা হলে কথা হয়। আইনস্টাইনের থিয়োরি থেকে ব্ল্যাক হোলের উৎপত্তি, কিন্তু তিনি ব্ল্যাক হোলে বিশ্বাস করতেন না! ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণের টান এতই প্রবল যে, আলোর কণাও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, তাই সে কৃষ্ণ— ব্ল্যাক।
ছাত্রাবস্থায় রজার কেমব্রিজের ছাত্র, মাস্টারমশাই ডেনিস সিয়ামা। ফ্রেড হয়েল, জয়ন্ত নারলিকার, সিয়ামা-র বিশ্বরূপ দর্শনে বিশ্বজগৎ স্টেডি স্টেটই থাকে; ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি, শূন্যতাকে আবার নতুন করে তৈরি করে নেওয়া। বিশ্বজগতে কোনও পরিবর্তন নেই।
রজার পরে অক্সফোর্ডে চলে আসেন, রাউজ় বল অধ্যাপক হয়ে। ওঁর চেয়ে বয়সে ছোট, প্রয়াত স্টিফেন হকিং জীবৎকালে কেমব্রিজের লুকাসিয়ান অধ্যাপক ছিলেন, যে পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন আইজ়্যাক নিউটন। ‘পেনরোজ়-হকিং সিঙ্গুলারিটি’ কি তবে বিশ্বজগতের আদি মুহূর্তের সৃষ্টির দামামা— ‘বিগ ব্যাং’? প্রথম দিকে এই তত্ত্ব নেহাতই অঙ্কের, কতগুলি সমীকরণের সমাধান সূত্র। রজার ওই সিঙ্গুলারিটির বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন, স্থান ও কালের প্রেক্ষিতে। বহু যুগ পরে ওই আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে পেলেন নোবেল পুরস্কার। হকিং বেঁচে থাকলে হয়তো রজারের সঙ্গে নোবেল পেতেন। তিনি অবশ্য তাঁর সমীকরণ নিয়ে চিরনিদ্রায়, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-তে।
কয়েক বছর আগে রজার ও তাঁর স্ত্রী ভেনেসাকে দার্জিলিঙে নিয়ে গিয়েছিলাম। উইন্ডেমিয়ার হোটেলে, ভুটানের রাজকন্যা ম্যাডাম তেন্ডুলফা-র নিমন্ত্রণে। ভেনেসা অসুস্থ হলেন। হোটেলেই সময় কাটাতাম। রজার গল্প শুরু করলেন। তাঁর অত্যাধুনিক ও বিস্ময়কর চিন্তাধারা আমাকে বোঝাবেনই— বিশ্বজগতের সৃষ্টির কী বিচিত্র রূপ! থিয়োরিটার নাম ‘কনফর্মাল সাইক্লিক কসমোলজি’ (সিসিসি)। এই থিয়োরি বিগ ব্যাং-কে ডিঙিয়ে সময়ের অতীতে মানুষের দৃষ্টি টেনে নিয়ে যায়। মুহূর্তেই বোঝা গেল, এই থিয়োরির এক অসাধারণ সৌন্দর্য ও ছন্দ আছে। বিজ্ঞানীদের মাথায় যখন নতুন ভাবনা আসে, তা সাফল্য পেলে, তাঁরা গবেষণা প্রবন্ধ লেখেন, এবং ভাল পত্রিকায় ছাপান। রজার সাদামাটা বিজ্ঞানী নন, তিনি এই অভাবনীয়কে রূপ দিলেন বইয়ে— সাইকল্স অব টাইম: অ্যান এক্সট্রাঅর্ডিনারি নিউ ভিউ অব দ্য ইউনিভার্স (২০১০)।
ব্যাপারটা হল এ-ই যে, আমাদের বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়েছিল বিগ ব্যাং-এ, এক অকল্পনীয় শক্তি ফেটে গিয়ে। কিন্তু এই শক্তি এল কোথা থেকে? রজার বোঝাচ্ছেন, বিগ ব্যাং-এরও আগে আর একটি বিশ্বজগৎ ছিল, আর একটি বিশ্বজাগতিক যুগে। সেই বিশ্বজগৎ সময় ও কালের সঙ্গে আমাদের এই বিশ্বজগতের মতোই ফুলছে। হাওয়া দিলে যেমন বেলুন ফোলে। বিশ্বজগৎ ফেঁপে উঠছে ওই আদি শক্তির বলে। এই পদ্ধতি চলতে চলতে এমন একটা সময় আসবে, যখন বিশ্বজগতের সব শক্তিই বিলুপ্ত হয়ে, অসম্ভব ঠান্ডা হয়ে বিশ্বজগৎ কবর-জগৎ হবে। এতই ঠান্ডা হবে যে, কোটি কোটি ব্ল্যাক হোলও বিশ্বজগতের তাপমানের থেকে কিঞ্চিৎ গরম থাকবে। তখন এই কোটি কোটি ব্ল্যাক হোল থার্মোডায়ানামিক্স-এর দ্বিতীয় আইন অনুসারে একসঙ্গে ফাটবে; সে-ই হল দ্বিতীয় বিশ্বজগতের সৃষ্টির বা বিগ ব্যাং-এর শক্তির উৎস, আর এক বিশ্বজাগতিক যুগের শুরু।
এক যুগ থেকে আর এক যুগ, এটাই ধ্বংস আর সৃষ্টির তাণ্ডব নৃত্য। আমার শুনে মনে হল, ভগবদ্গীতার কথা, যুদ্ধের আগে। মনে হল, রজার সেটা জানেন।
প্রমাণ কী এই সব উদ্ভট ভাবনার? আগামী মার্চে রজারকে কলকাতায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নেমন্তন্ন করেছি। আগে এটা জুনে হওয়ার কথা ছিল, অবশ্যই হয়নি। এক কথায় রাজি হয়েছেন রজার।
এই প্রসঙ্গে ওঁর পাঠানো অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এবং টাইটল থেকে উদ্ধৃতিমূল পাঠকদের কাছে নিবেদন করছি। “আর উই সিইং হকিং পয়েন্টস ইন দ্য মাইক্রোওয়েভ স্কাই?” যাঁরা মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁরা কি এই বিশ্বজগতের আগে, বিগ ব্যাং-এর অতীতে আর একটি বিশ্বজগৎ ছিল, এমন কিছু দেখেছেন? হকিং পয়েন্টস হল, আমাদের চাঁদের ৮ গুণ বড় বিন্দুবিশেষ। এরা আসলে এক কালে ছিল অত্যন্ত বড় ব্ল্যাক হোল, ১০০ কোটি সূর্যের সমান। অতীতের বিশ্বজাগতিক যুগে গোটা গ্যালাক্সিটাকে গিলে খেয়ে নিয়েছিল তার খিদে মেটানোর জন্য। হকিং বিকিরণে সব শক্তি বিলুপ্ত হয়ে শেষে ছোট বিন্দুতে পরিণত হয়। এই হকিং পয়েন্টস ‘সিসিসি মডেল’ অনুযায়ী এক বিশ্বজাগতিক যুগ থেকে আর এক দ্বিতীয় বিশ্বজাগতিক যুগে যাওয়ার জানলাবিশেষ। আশ্চর্ষের কথা, হকিং পয়েন্টগুলির অস্তিত্ব আমরা দেখেছি; এটাই হল চরম প্রমাণ, এক বিশ্বজগতের কবর থেকে আর এক বিশ্বজগৎ সৃষ্টি হয়ে চলেছে।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বজগতে আদি বা অন্ত বলে কিছু নেই। সময়ের না আছে শুরু, না আছে শেষ। স্থানের শুরু বা শেষ নেই। নিরন্তর তারা অতিবাহিত হচ্ছে ধ্বংস আর সৃষ্টির মাধ্যমে।
শেষে বলি, বিগ ব্যাং রইল, কিন্তু সেটা শেষ কথা নয়। অনন্ত কাল ধরে অনন্ত বিগ ব্যাং হয়ে চলেছে, এবং হবে। ঘুরে ফিরে হয়েল, নারলিকার, সিয়ামার স্টেডি স্টেট বিশ্বজগৎ নয় তো?
রজার এক অসাধারণ বিজ্ঞানী এবং গভীর চিন্তাশীল মানুষ। তাঁর কল্পনার জগৎ বিশ্বজগতের সীমায়। কিন্তু মানুষটি অতি বিনয়ী ও মিশুকে। গল্প করতে ভালবাসেন। এবং, বাঙালির নিকটজন।
প্রাক্তন অধিকর্তা, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স ও ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার