সঙ্কট যে এখনই মিটিবার নহে, তাহা বিভিন্ন মূল্যায়নে স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারও জানাইয়াছে, বর্তমান অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার মোট উৎপাদনের পরিমাণ ৪.৫ শতাংশ হ্রাস পাইবার সম্ভাবনা। এত দিনে এই কথাটিও সকলেই মানিয়া লইয়াছেন যে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার মূল সমস্যা চাহিদার। কিন্তু, এই সঙ্কটে জোগানজনিত সমস্যাও আছে। লকডাউনের ফলে শিল্প-উৎপাদন যে ধাক্কা খাইয়াছে, এবং শ্রমিকের অভাবে যে সমস্যা এখনও চলিতেছে, তাহা বাজারের পণ্যের জোগানকেও স্বাভাবিক হইতে দিতেছে না। অতএব, এক দিকে বাজারের চাহিদাবৃদ্ধি, আর অন্য দিকে শিল্পক্ষেত্রে নগদের জোগান বজায় রাখা, আর্থিক মন্দার বিরুদ্ধে দুইটি অস্ত্রই প্রয়োগ করিতে হইবে। চাহিদা বাড়াইবার কেন্সীয় ব্যবস্থাপত্র হইল মানুষের হাতে টাকার জোগান দেওয়া। ‘প্রয়োজনে গর্ত খুঁড়িবার জন্য টাকা খরচ করিতে হইবে; এবং তাহার পর সেই গর্ত বুজাইতে ফের খরচ করিতে হইবে’— প্রবাদে পরিণত হওয়া এই পরামর্শটি ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্যপালনীয়। অর্থাৎ, সরকারকে খরচ করিতে হইবে।
সরকারি ব্যয় বাড়াইবার অর্থ রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণও বাড়া, বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে, যেখানে কররাজস্ব আদায়ের পরিমাণ নিম্নমুখী। কিন্তু, রাজকোষ ঘাটতি লাগামছাড়া হইলেও সমস্যা— তাহাতে দেশের ক্রেডিট রেটিং কমিবে, আন্তর্জাতিক লগ্নির পরিমাণও কমিবে। এই পরিস্থিতিতে একটি পন্থার কথা শোনা যাইতেছে— রাজকোষ ঘাটতির মনিটাইজ়েশন বা মুদ্রায়ণ। প্রক্রিয়াটি ১৯৯৭ সাল অবধি ভারতে প্রচলিত ছিল। সহজ ভাষায়, সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নিকট সরাসরি ঋণ লইবে এবং রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সেই ঋণের জোগান দিবে নূতন নোট ছাপাইয়া। এই ব্যবস্থার একটি ইতিবাচক দিক হইল, যেহেতু সরকার বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক হইতে ঋণ লইবে না, ফলে বেসরকারি লগ্নিকারীদের জন্য বাণিজ্যিক ঋণের অভাব ঘটিবে না— পরিভাষায় যাহাকে বলে ‘ক্রাউডিং আউট’, সেই বিপত্তি এড়ানো সম্ভব হইবে, অন্তত প্রাথমিক পর্বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ভারতে জোগানের সমস্যাও যথেষ্ট। সরকার কখন ঋণ করিবে, এবং কতখানি করিবে, তাহাও বিচক্ষণতার সহিত স্থির করিতে হইবে। অর্থনীতিবিদদের একাংশের মত, অর্থবর্ষে মোট যত ঋণের পরিকল্পনা আছে, বৎসরের প্রথমার্ধেই তাহার অধিকতর অংশটিই লওয়া বিধেয়। তাহাতে বাজারে দ্রুত চাহিদা ফিরিবে, এবং সেই পণ্যের উপর যে পরোক্ষ কর আদায় করা হইবে, তাহা রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখিতে খানিক সহায়ক হইবে।
রাজকোষ ঘাটতির মুদ্রায়ণের সর্বাপেক্ষা বড় বিপদ হইল, তাহাতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটিবে। কারণ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক নূতন টাকা ছাপাইবার একটি সম্ভাব্য পরিণাম: প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ এক থাকিলেও নগদের পরিমাণ বাড়িবে, ফলে পণ্য ও পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধি হইবে। তাহার প্রভাব পড়িবে শিল্পক্ষেত্রেও। তবে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সম্ভাবনা সত্য হইবার আশঙ্কা তুলনায় কম, কারণ বর্তমানে মূল সমস্যা চাহিদার অভাবের। কাজেই, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করিবার জন্য সময় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে থাকিবে। সুদের হার যেহেতু এখন ঐতিহাসিক ভাবে কম, ফলে সেই হার বাড়াইয়া মূল্যস্ফীতির প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করিবার রাস্তাটি আছ। কিন্তু, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষতা, এবং অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা প্রয়োজন। অর্থনীতির প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে চলিতে অভ্যস্ত, তাহাতে আশঙ্কা হয়, সমাধানের পথ খুঁজিতে গিয়া সমস্যা আরও তীব্রতর না হইয়া উঠে। কর্তারা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে চলিবার সু-অভ্যাসটি তৈরি করিতে পারিলে মঙ্গল।