নিয়াজ খান।
সবচেয়ে বড় সমস্যা তাঁর নামটাই, মনে করছেন সরকারি আমলা। অতএব নিজের নামটাই বদলে ফেলার কথা ভাবছেন। কোনও লুকোছাপা নেই, খোলাখুলিই এ কথা জানিয়েছেন নিয়াজ খান। মনে রাখবেন, নিয়াজ খান কিন্তু কোনও সাধারণ নাগরিক নন, তিনি মধ্যপ্রদেশ সরকারের একজন আমলা অর্থাৎ উচ্চপদস্থ কর্তা। ‘নিয়াজ’ নাম এবং ‘খান’ পদবী ক্রমশ তাঁকে বিপন্ন করে তুলছে— এমনই মনে হচ্ছে এখন ওই আমলার।
কোথায় পৌঁছচ্ছি আমরা ক্রমশ! নাম বা পদবীর কারণে মার্কিন বিমানবন্দরে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে একাধিক ভারতীয় নাগরিককে, সে সব আমরা শুনেছি। নাম বা পদবীর কারণে মার্কিন দেশে হেনস্তার মুখে পড়তে হয়েছে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামকে, সে-ও আমরা জানি। কিন্তু নাম বা পদবীর কারণে ভারতীয় নাগরিককে ভারতেই বিপন্ন বোধ করতে হবে, এ কেমন কথা! ধর্মীয় বা জাতিগত কারণে ভারতে কেউ এই প্রথম হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, এমন অবশ্য নয়। দেশের সব প্রান্ত থেকেই এই ধরণের অপরাধের খবর আসা ইদানীং বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু এই সব সাম্প্রদায়িকতার প্রেত রোখা হবে যে সরষে দিয়ে, তার মধ্যেই ভূত। উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্তাও জানাচ্ছেন, তাঁর নাম, তাঁর পদবী তাঁকে বিপন্ন করছে, তাঁর পরিবারকে বিপন্ন করছে, প্রায় অচ্ছুত করে তুলছে। পরিস্থিতি যদি এই পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমরা মোকাবিলা করব কী ভাবে?
ভারতের, ভারতীয় সভ্যতার, ভারতীয় সংস্কৃতির কাঠামোয় নাম-পদবী ব্যক্তির শিকড়ের পরিচয় বহন করে। কারও ক্ষেত্রে পারিবারিক পরিচয়, কারও ক্ষেত্রে পূর্বসুরিদের পরিচয়, কারও ক্ষেত্রে তাঁর জন্মস্থান বা বাসস্থান বা গ্রাম-জনপদের পরিচয়— আমাদের দেশে এত কিছুর পরিচয় বহন করে নাম। নাম ব্যক্তির অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনও এক মৌলবাদী বা কট্টরবাদী প্রবণতা কি কারও কারও ক্ষেত্রে সেই অস্তিত্বটাকেই ধাক্কা দিতে চাইছে? বিপুল ভারতীয় জনগোষ্ঠী তার অস্তিত্বের বিভিন্নতাতেই পরিচিত গোটা বিশ্বে। সেই বিভিন্নতাই কি মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে?
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
এ কথা ঠিক যে, আমার বা আপনার নাম কী হবে, তা আমার বা আপনার হাতে থাকে না, নামকরণ অন্য কারও দ্বারা হয়। পদবীও পারিবারিক সূত্রেই মেলে। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই নাম-পদবীই আমাদের অন্যতম পরিচয় হয়ে ওঠে, আমাদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ওঠে। আমরা দেশের কোন অংশের বা কোন প্রান্তের প্রতিনিধিত্ব করি, আমাদের ভাষা কী, সংস্কৃতি কী, খাদ্যাভ্যাস কী— এই সব কিছুর পরিচয় সগর্বে বয়ে নিয়ে বেড়ায় ওই নামটা। সুস্থ-সবল ভাবে, সসম্মাণে বা নিরুপদ্রবে বাঁচতে হলে সেই নামটাকেই গোপন করতে হবে, এমন ধারণা কোনও নাগরিকের মনে তৈরি হলে গোটা দেশের পক্ষেই তা দুর্ভাগ্যজনক।
আরও পড়ুন: নিজের মুসলিম নাম বদলে ফেলতে চান মধ্যপ্রদেশের এই আমলা, কারণটাও জানিয়েছেন
এই দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি কেন আমাদের বারবার দাঁড়াতে হচ্ছে, তা যে ভেবে দেখা দরকার, সে সতর্ক বার্তা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু ভেবে দেখছি না। ভেবে দেখলে পরিস্থিতি দিন দিন এত খারাপ হয়ে উঠত না। মধ্যপ্রদেশের কোনও একপ্রান্তে কোনও এক ব্যক্তির মনে হয়েছে যে, তিনি বিপন্ন, বিষয়টা এরকম নয়। নাম-পদবীর কারণে বা জাত-ধর্মের পরিচয়ের ভিত্তিতে সহ-নাগরিকদের বিপন্ন বা আক্রান্ত হতে আমরা বারবার দেখছি। এবং আবার বলছি, এবার যিনি নিজের বিপন্নতার কথা জানিয়ে নাম-পদবী বদলে ফেলার ভাবনা প্রকাশ করলেন তিনি কোনও সাধারণ নাগরিক নন। এর পরেও যদি কেউ বলেন যে, পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতা অনুভব করতে পারছেন না, তাহলে তিনি ভাবের ঘরে চুরি করছেন।
প্রশাসনও কি অপারগ তাহলে? কী করে তা বলবো? এই প্রশাসনই তো এই বিপুলায়তন দেশকে, এই প্রকাণ্ড জনগোষ্ঠীকে সুসংহত এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। অতএব প্রশাসনের পারগতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ কমই। আর একটু উঁচুতে তাকানো যাক। প্রশাসন যাঁদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বই এই প্রশাসনিক অপারগতার শিকড় নয় তো? এই প্রশ্নটা কিন্তু উঠছে অনেক দিন ধরে। নিয়াজ খান অনুচ্চারেই আরও জোর দিয়ে প্রশ্নটা তুলে দিলেন। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’— এই স্লোগান দেওয়ার আগে স্লোগানের স্বার্থকতার বিষয়টাও ভেবে নেওয়া দরকার এবার।