নেতৃমুখ: নির্বাচনী প্রচারে অপ্রত্যাশিত সাফল্য পেলেন লালু প্রসাদ-পুত্র ও বর্তমান আরজেডি প্রধান তেজস্বী যাদব, মুজফ্ফরপুর, ৫ নভেম্বর। পিটিআই
মঙ্গলবারের বারবেলাটা যে এমন ‘নখরদংশন’ উত্তেজনায় কাটবে, তা আগে কে জানত? আইপিএল ফাইনালের সন্ধেয় যে বিহারে আর এক ‘আইপিএল’ (ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল লিগ) জনপ্রিয়তা ও হৃৎস্পন্দন বাড়ানোয় পাল্লা দেবে, তা-ই বা কি সকালবেলায় বোঝা গিয়েছিল?
সকালটা শুরু হয়েছিল দেশের তাবড় ভোট পণ্ডিতদের ‘বুথ ফেরত সমীক্ষা’-র মুখ রেখেই। দীর্ঘ পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকার পর বিহারে নীতীশ কুমার ফের জয়ী হয়ে কি লালু প্রসাদ যাদবের মুখ্যমন্ত্রিত্বের রেকর্ড ভেঙে দেবেন, না লালুর তরুণ পুত্র তেজস্বী তাঁর তারুণ্য ও দীর্ঘ দিন জমে থাকা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়ায় ভর করে রাজনৈতিক সুনামিতে নীতীশ তথা রাজ্যের শাসক জোটকে (যার অন্যতম শরিক বিজেপি) ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন— এই প্রশ্নে প্রায় সব ক’টি সমীক্ষারই কম-বেশি মত তেজস্বী ও ‘পরিবর্তন’-এর পক্ষেই ছিল। সেই মতো সকালের প্রাথমিক ভোট গণনায় কংগ্রেস ও বামদের সঙ্গী করে রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) ‘মহাগঠবন্ধন’ শাসক-জোট এনডিএ-র চেয়ে এগিয়ে থাকছিল ২০-২৫টি আসনে। কিন্তু বেলা যত দুপুরের দিকে গড়াল, তত ‘ব্যবধান’ কমতে লাগল এবং এক সময় জেডি(ইউ) আর বিজেপি ‘মহাগঠবন্ধন’-এর সঙ্গে ২৫-৩০টি আসনের ব্যবধানে এগিয়ে গেল।
আসনের ব্যবধানের দিক থেকে এনডিএ এগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও ছাড়িয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ভোটের ব্যবধান চমকে দেওয়ার মতোই ‘চুলচেরা’। অতিমারির নিয়মে প্রতি বুথে ভোটার সংখ্যা দেড় হাজার থেকে এক হাজার হওয়ায়, বুথের সংখ্যাও বেড়েছে, ইভিএম-এর সংখ্যাও। তদুপরি শারীরিক দূরত্ববিধির বাধ্যবাধকতায় গণনার কাজ এগিয়েছে শম্বুকগতিতে। তারই মধ্যে দুপুর নাগাদ দেখা যাচ্ছিল, ৭০টির মতো আসনে অগ্রবর্তী ও পিছিয়ে থাকা প্রতিপক্ষদের মধ্যে ব্যবধান হাজারের কম, দুপুর চারটে নাগাদও তা বজায় রইল প্রায় ৫০টি আসনে— যদিও তখনও প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি ভোট গোনা বাকি! দুপুরের দিকেই নির্বাচন কমিশন অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, শেষ ফল আসতে রাত গভীর হতে পারে। কোনও একটি পক্ষের সামান্য ব্যবধানে জয়, অথবা কোনও পক্ষেরই নির্ণায়ক জয় ছাড়া ‘ত্রিশঙ্কু’ (‘হাং’) বিধানসভা, এই দুই সম্ভাবনা নিয়েও প্রধান দুই পক্ষই অনেক সময় অবধি জয়ের আশা ও রক্তচাপ বাড়িয়ে তুলল। এনডিএ শেষে কান ঘেঁষে জিতলেও (যদিও আরজেডি-র দাবি, প্রশাসনকে ‘ব্যবহার’ করে তাদের হারিয়ে দেওয়া হচ্ছে), প্রশ্ন থেকে গেল— ভোট পণ্ডিতরা এমন পরিস্থিতির তল পেলেন না কেন? তরুণদের কর্মসংস্থান, করোনায় আর্থিক মন্দা, বিশেষত বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকদের শোচনীয় দুর্দশার মতো প্রতিষ্ঠানবিরোধী বিষয়গুলো তো ছিলই, সঙ্গে কোথাও যেন যুক্ত হচ্ছিল শাসক হিসেবে নীতীশ কুমারের ‘ক্লান্তি’ও, যা প্রকট হল পূর্ণিয়ার জনসভায় তাঁর নাটকীয় ঘোষণায়— “এটাই আমার শেষ নির্বাচন। সব ভাল তার, শেষ ভাল যার।” এটা কি নেহাতই ভোট জিততে আবেগি প্রার্থনা, না এর মধ্যে কিছু মৌলিক চিন্তাও আছে, তা বুঝতে সংখ্যাতত্ত্বের আপাত-উত্তেজনা ছেড়ে বিহার-রাজনীতির অন্দরেরও কিছু গভীর কথা মনে রাখা ভাল।
১৯৭৫ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘লোক সংঘর্ষ’ আন্দোলন সর্বভারতীয় স্তরে ইন্দিরা গাঁধীর শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তার তিন তরুণ নেতা— লালু প্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার ও সুশীল মোদী, ১৯৯০-এর দশক থেকে তিন দশক ধরে কার্যত বিহার রাজনীতি শাসন করেছেন। পাশাপাশি ছিলেন হাজিপুর থেকে বার বার সংসদে নির্বাচিত হওয়া দলিত (দুসাদ) নেতা, রামবিলাস পাসোয়ান— যিনি জনতা পার্টি হয়ে পরে লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপি) গড়ে দেবগৌড়া-গুজরাল হয়ে বাজপেয়ী, মনমোহন সিংহ ও নরেন্দ্র মোদী অবধি নানা রঙের সব প্রধানমন্ত্রীর আমলেই আমৃত্যু কেন্দ্রের মন্ত্রী থেকে গেছেন। তাঁর প্রয়াণের পর পুত্র চিরাগ এখন এলজেপি-র সর্বেসর্বা, যিনি বিহার ভোটের আগে এনডিএ ছেড়ে নীতীশ-বিরোধী অথচ বিজেপি-প্রেমী অবস্থান নিয়ে দিকে দিকে কখনও মহাজোট, কখনও শাসক-জোটের আসন সম্ভাবনা উঠিয়েছেন এবং নামিয়েছেন!
লালু প্রসাদ ও নীতীশ কুমার ১৯৭৭-এর পর, জরুরি অবস্থা-র অবসানের পর, জনতা পার্টি ও জনতা দল হয়ে যথাক্রমে রাষ্ট্রীয় জনতা দল (যাদব-প্রধান) ও সমতা পার্টি (কুর্মি-প্রধান) গড়ে ‘সামাজিক ন্যায়’ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে বিহারে যে জাতপাতের রাজনীতির প্রবর্তন করেন— তারই নানা সমীকরণ পরে বিহার রাজনীতির প্রধান ভিত্তি হয়ে ওঠে। এর মধ্যে লালু প্রসাদের প্রচণ্ড দাপটে নীতীশ কুমার পুরনো জনতা পার্টির জর্জ ফার্নান্ডেজ়ের সঙ্গে মিলে লালু-বিরোধী হয়ে ওঠেন। সুশীল মোদী অবশ্য বরাবরই বিজেপি-তে থেকে গেছেন— তিনিও দলীয় মতাদর্শের কারণে বরাবরই লালু-বিরোধী। ফলে, ১৯৯০-এর দশকের শেষাশেষি, অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এনডিএ সরকার স্থাপিত হলে বিহারে বিজেপি ও সমতা পার্টি— পরে জেডি(ইউ)— পরস্পরের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৫ ও ২০১০-এ বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে মুখ্যমন্ত্রী থাকা নীতীশ ২০১৫-য় রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও কংগ্রেসের হাত ধরে ফের ক্ষমতায় আসীন হন, কিন্তু মাস কুড়ি পর, লালু-পুত্র তেজস্বীর সঙ্গে তীব্র মতভেদের কারণে (নীতীশের মতে, তেজস্বীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে) মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে ফের সুশীল মোদীর (বিজেপি) সঙ্গে জোট গড়েন।
লালু প্রসাদ ও তাঁর স্ত্রী রাবড়ী দেবীর পনেরো বছরের শাসনকালে বিহার যেমন চূড়ান্ত সংরক্ষণ ও জাতপাতের সমীকরণের রাজনীতি দেখেছে, তেমনই দেখেছে নানা দুর্নীতি, এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রবল অবনতিও। ফলে, অনেকের চোখে বিহার হয়ে উঠেছিল ‘তমিস্রার রাজ্য’। নীতীশের সময় ‘বিজলি-সড়ক-পানি’র মতো উন্নয়নের কিছু মৌলিক পরিকাঠামোর পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলারও প্রথম দিকে লক্ষণীয় উন্নতি হয়, ‘সুশাসন-বাবু’ আখ্যাও পান তিনি। কিন্তু তার সঙ্গে, বিশেষত গত পাঁচ বছরে, তাঁর ‘দুর্নীতিমুক্ত’ ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বার বার পক্ষ বদলের ছবিও, তকমা জোটে ‘পাল্টি-কুমার’-এর! যদিও, গোড়ায় রাজ্যের মহিলাদের অকুণ্ঠ সমর্থনও পেয়েছেন— পঞ্চায়েতে ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ, আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ও ‘মদ’ বন্ধ করার জন্য (যার ফলে পারিবারিক হিংসা অনেকটা কমেছিল)। এই নারী সমর্থন বোধ হয় এ বারও খানিকটা ধরে রাখতে পেরেছেন তিনি।
অন্য দিকে, লালু-পুত্র তেজস্বীও চেয়েছেন দলের সামাজিক ভিত্তি ‘মুসলিম-যাদব’-এর সঙ্গে, অর্থনৈতিক ন্যায়ের কথা বলে, ১০ লক্ষ সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে, জাতপাত-সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ভাবে যুব সম্প্রদায়কে যুক্ত করতে। এই ভাবে, লালু প্রসাদের উত্তরাধিকার বয়েও তাঁর রাজনীতির আঙিনার অনেকটা ‘বাইরে’ পা ফেলতে চেয়েছেন তেজস্বী। এমনকি নরেন্দ্র মোদী তাঁকে ‘জঙ্গলরাজের যুবরাজ’ বললেও, পাল্টা কুকথা বলেননি তিনি— শান্ত, সংযত থেকে দিন-রাত সভা করে সমস্ত বিহার চষেছেন। তাঁর এই রাজনৈতিক শৈলী যুবমহলে সাড়াও ফেলেছিল খুব। এতেই কি তৃপ্ত হয়ে রাজ্যের পূর্বভাগ, মুসলিম অধ্যুষিত ‘সীমাঞ্চল’-এ সে ভাবে সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রচার করলেন না? তার সুযোগেই কি এই অঞ্চলে আরজেডি-র প্রথাগত সংখ্যালঘু সমর্থনভিত্তিতে ভাগ বসিয়ে নিজের পাঁচটি আসন সুনিশ্চিত করলেন আসাউদ্দিন ওয়াইসি? তবে, মহাজোটের নানা বিপর্যয় সত্ত্বেও সিপিআইএমএল-এর নিজস্ব ‘পকেট’-এ দলিত ভোট ধরে রেখে চমকপ্রদ সাফল্য এবং সঙ্গে সিপিআই ও সিপিএম-কে নিয়ে ১৭-১৮টি আসন প্রাপ্তি, বিহারে তো বটেই, বাংলাতেও কিছুটা অক্সিজেন জোগাবে।
জাতীয় দল হিসেবে মহাজোটে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কংগ্রেসের। বামেদের চেয়ে মাত্র তিনটি আসন বেশি পেয়ে (২০) ভারতের প্রাচীনতম দলটি তেজস্বীর ওপরে বোঝা হয়েই রইল। তবে সবচেয়ে করুণ অবস্থা নীতীশ কুমারের। এমনিতেই, দুর্জনের মতে, চিরাগ পাসোয়ানকে দিয়ে বিজেপিই আসলে ভোটের আগেই মোদী-র প্রশংসা আর নীতীশের তীব্র নিন্দা করিয়ে রেখেছে। এ বার নীতীশের দলের দুর্দশা দেখে (এই লেখার সময় জেডিইউ ৪৩, বিজেপি ৭৪) এখন বিজেপি দাবি করছে মুখ্যমন্ত্রিত্ব। তার আগাম আভাস পেয়েই কি নীতীশের পূর্ণিয়ায় ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাস’-এর ঘোষণা? তার ফলে কি কখনও মহারাষ্ট্রে শিবসেনার মতো এনডিএ-র সঙ্গ ছেড়ে ইউপিএ-র হাত ধরার সম্ভাবনাও থাকছে? তবে, ভুল থেকে দ্রুত শিক্ষা নেওয়া বিজেপি আগেই গোড়া মেরে রেখেছে। নানা সভায় মোদী-শাহ গেয়ে রেখেছেন, ১০টি আসন পেলেও নীতীশই আবার মুখ্যমন্ত্রী! এক জন ‘অসহায়’ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে নীতীশ সত্যি ‘সন্ন্যাস’ নেন কি না, সেটাই দেখার!
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়