আওতেয়ারোয়া (নিউজ়িল্যান্ড) বা শ্বেত-সুদীর্ঘ মেঘের দেশে এসে বুঝতে পারছি, করোনাভাইরাসের মতো শত্রুর সঙ্গে লড়তে গেলে আমাদের নিজেদেরই কতটা পাল্টাতে হবে। একশো দুই দিন করোনা-মুক্ত থাকার পর এই সবে এই দেশের অন্যতম প্রধান শহর অকল্যান্ডে লকডাউনের ঘোষণা শোনা গেল। কিন্তু এখনও অন্যান্য দেশের তুলনায় নিউজ়িল্যান্ড নিরাপদ, আক্রান্তের সংখ্যা হাতে গোনার মতোও নয়। এ দিকে উত্তরোত্তর রোগ বৃদ্ধি ঘটছে আমার দেশ ভারতে, আমার শহর কলকাতায়। দেশ তো আসলে মা নয়, সন্তানসম। বোধ করি তাই জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে বিদেশে বসে ভািব, কী করে এবং কেন অন্যের শিশু এই দুর্দিনেও হেসে-খেলে, ছুটে বেড়ায় আর আমার দেশ ‘দুবেলা মরার আগে’ জানতেও পারে না তার ন্যূনতম প্রাপ্য কী ছিল, কী হতে পারত তার অধিকার।
‘অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্যকর্মী’ হওয়ার কারণে এখানকার হাসপাতাল বিশেষ অনুরোধ জানাল অভিবাসন দফতরকে, আমার বিশেষ অনুমতি ত্বরান্বিত করতে লেভেল ফোর লকডাউনের মধ্যেও। মন ছুঁয়ে গিয়েছিল তখনই। দরকারে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিতে এরা কখনও পিছপা নয়। কথা হল, কী সেই দরকার? মানুষের মনের স্বাস্থ্যোদ্ধার। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি কতটা যত্নবান, সংবেদনশীল ও দায়বদ্ধতা থাকলে সংক্রমণের অতিমারিতেও মানসিক স্বাস্থ্য এতটা অগ্রাধিকারী হয়ে উঠতে পারে!
অভিবাসন থেকে বেরনোর পরমুহূর্তেই টের পাওয়া গেল পুলিশ, আধা সামরিক এবং সামরিক প্রচেষ্টায় দু’সপ্তাহের সামাজিক পৃথকীকরণ (সোশ্যাল আইসোলেশন) কত স্বচ্ছন্দে ও অবলীলায় করছে এরা। এই পৃথকীকরণ চলল অকল্যান্ড শহরের হোটেলে, নিরবচ্ছিন্ন দু’হপ্তা। শুরু থেকে শেষ অবধি তারা কখনওই ভুলল না প্রতি দিন স্বাগত এবং ধন্যবাদ জানাতে। অথচ নিয়মের বাঁধন স্পষ্ট ও জোরালো। বেশির ভাগই খুশি মনে মেনে নিয়েছেন ‘চলো নিয়মমতে’। যে দু’-চার জন ব্যতিক্রমী মানুষ নিয়ম ভেঙে গর্বিত, তাঁদের বেশির ভাগই দেখলাম ভারতীয় বংশোদ্ভূত!
এই সব সামাজিক পৃথকীকরণ, রোগ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনে চিকিৎসার বিপুল খরচ সম্পূর্ণত বহন করে এ দেশের সরকার, তথা করদাতা নাগরিকরা। দেখেশুনে আবার তুলনা মনে এল। আমরা আমাদের দেশে কেমন নিজেরটুকু হয়ে গেলেই উটপাখি হয়ে যেতে ভালবাসি। বালিতে মুখ গুঁজে ভাবি, প্রলয়বাবু দেহ রেখেছেন। বাঁচাটা যেন মুহূর্তসর্বস্ব, পাশের লোকটার যা হয় হোক। কথা হল, আমি তো এ-বেলা বেঁচে গেলাম, কিন্তু যদি ও-বেলা, কিংবা কাল, কিংবা তারও অনেক পর অবধি বাঁচতে হয়, তা হলে? তখন আমার বিপদেও যে কাউকেই পাশে না পেতে পারি, এ যেন আমরা জেনেও বুঝি না। তাই আমরা নিশ্চিন্তে বাড়িতে লকডাউন যাপন করি, আর রাস্তায় শয়ে শয়ে মাইল হাঁটে গরিব লোক। সমমর্মিতার অভাব যে কী ভয়ঙ্কর আকার নিতে পারে, তা ভারতের মতো খুব কম দেশই বুঝিয়ে দিতে পারে। নিউজ়িল্যান্ড ধনী দেশ, আমরা গরিব, এই কথা বললে তাই পুরোটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আরও কিছু গভীর, গভীরতর কারণ আছে এই পার্থক্যের।
নিউজ়িল্যান্ডে যে কোভিড-এর প্রকোপ কমের মধ্যে আটকানো গিয়েছে, সেটা এমনি নয়। এটা একটা সামাজিক মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধের গল্প। মাস দুয়েক আগে প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদত্যাগ করলেন। কেন? কেননা, লকডাউন চলাকালীন তিনি দুই কিমি সাইকেল চড়ে পাহাড়ে উঠেছিলেন। নিয়মভঙ্গ, তাই পদত্যাগ।
এ হল সরকারি পক্ষ। বিরোধী পক্ষও কম যায় না। বিরোধী দলের এক পার্লামেন্টারিয়ান ভুল করে আঠারো জন কোভিড রোগীর নাম দিয়ে ফেলে ছিলেন সংবাদমাধ্যমে। কৃতকর্মের দায় নিয়ে নিজেই জানালেন, শুধু পদত্যাগই করলেন না, বিদায় নিলেন রাজনীতি থেকে, চিরতরে। তাও আবার জাতীয় নির্বাচনের মাত্র দুই মাস আগে। মনে ভাবলাম, খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে কী দারুণ সব সংবাদ জানতে পারে এ দেশ! ভাবলাম, আমাদের পরিস্থিতি কবে এ রকম হবে, কোনও দিন কি হবে? কখনও কি পাব এমন নেতা দেখতে, যাঁরা মানুষের প্রতি এত দায়বদ্ধ, নিজের সম্মানের প্রতিও? যাঁরা ভাবেন, “ধর্ম আমার মাথায় রেখে চলব সিধে রাস্তা দেখে”?
আর একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। এ দেশে এসে সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী করে পারলে তোমরা কোভিডকে হারাতে ও তাড়াতে। বললে, নিয়ম মেনেছে সব্বাই খুব জোর, একেবারে গোড়া থেকে। কথাটা ভাল করে বুঝলাম এই সে দিন। এক রোগিণী এলেন মাস্ক পরে। ক্ষমা চেয়ে বললেন গলায় সামান্য ঠান্ডা লেগেছে, সাবধানের মার নেই বলে ওটা পরে এসেছেন। সেই সঙ্গে বিনীত অনুরোধ জানালেন আমাকেও মাস্ক পরার জন্য।
মনে পড়ে গেল, কয়েক সপ্তাহ আগেই কলকাতায় রাস্তায় এক জনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম “দাদা, মাস্ক পরেননি?” তিনি যারপরনাই রেগে চেঁচিয়ে জানতে চাইলেন আমার জীবনের সমস্যাটা কোথায়! আমিও ভাবি, আমাদের জীবনের সমস্যাটা ঠিক কোথায়।
মন চিকিৎসক