—ফাইল চিত্র।
জীবনের যে ক্ষেত্রগুলিকে অতিমারির প্রকোপ প্রায় স্তব্ধ করিয়া দিয়াছিল, পর্যটন তাহার একটি। কোভিড-১৯’এর জেরে বিশ্বের বহু দেশ তো বটেই, এক-একটি দেশের রাজ্যগুলির সীমান্ত পর্যন্ত বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। বিমানবন্দরে বিমানের উঠানামা নাই, দূরপাল্লার ট্রেন নাই, সাগর-পাহাড়-অরণ্য পর্যটকবিরল হইয়া পড়িয়াছিল। অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাস ভ্রমণেচ্ছু মানুষকে প্রায় বৎসরকাল গৃহবন্দি করিয়া দিবে, হোটেল-মালিক হইতে ভ্রমণ পরিষেবা সংস্থা, এমনকি পর্যটনপ্রিয় নাগরিক, কেহই ভাবেন নাই। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ— দক্ষিণ গোলার্ধে বসন্তও— অতিক্রান্ত। শীত আসিয়াছে। বহু দেশে পর্যটনের মরসুম অনেকাংশেই ঋতুভিত্তিক, বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে এক-একটি স্থান প্রকৃতির শোভা, উৎসব ও পর্যটকে ভরিয়া উঠে। করোনার জেরে মানুষের ভ্রমণ-সম্ভাবনাই প্রশ্নের মুখে পড়িয়াছিল। বৎসরের শেষ ভাগে ক্রমে আলো আসিতেছে।
এই আলো এক নূতন আলো। কোভিড-কালে বা কোভিড-উত্তর পর্বে ভ্রমণের এক নূতন রূপ সেই আলোয় দেখা যাইতেছে। পর্যটনের সংজ্ঞা না হউক, রূপরেখা যে পাল্টাইবার মুখে, তাহা এক প্রকার নিশ্চিত। সীমান্ত খুলিয়াছে, বিমান ও অন্য পরিবহণ চালু হইতেছে, পর্যটন কেন্দ্রগুলিও বিজ্ঞাপনমুখর। কিন্তু বুঝা যাইতেছে, এখন হইতে ভ্রমণের সঙ্গী হইবে বিস্তর নিয়ম। এবং উহারা সাময়িক নহে, দীর্ঘস্থায়ী হইবে। বিদেশ হইতে আগত নাগরিকদের দুই সপ্তাহের বাধ্যতামূলক নিভৃতবাস নিয়ম করিয়াছে বহু দেশ। আবার ফিরিয়া আসিবার পরে স্বদেশেও একই বিধি। অর্থাৎ, কেহ পাঁচ দিনের জন্য বিদেশ ভ্রমণে গেলে, বেড়ানো ও নিভৃতবাস পর্ব মিলিয়া মাসাধিক কাল চলিয়া যাইবে। শুনিতে অবিশ্বাস্য লাগিলেও ইহা সত্য, কোভিড-উত্তর কালে ভ্রমণ এমন দীর্ঘ হইতে পারে। তাহার উপর রহিয়াছে কোভিড-পরীক্ষা, ফর্ম পূরণ ও প্রভূত নথি-তথ্য প্রদানের ন্যায় ক্লান্তিকর কাজ। তাইল্যান্ডের ন্যায় দেশ পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাইয়া বলিতেছে, অন্তত তিন মাসের জন্য আসিবেন। সংসার ও জীবিকার পিছুটানে তাহা সম্ভব কি না, সেই তর্কে যোগ হইয়াছে প্রতিযুক্তি, তাহা হইলে দেশের মধ্যেই ভ্রমণ করিলে হয়! আনলক-পর্ব হইতেই অভ্যন্তরীণ পর্যটনের সুযোগ ও সম্ভাবনা, দুই-ই বাড়িতেছে। আবার ঘর হইতেই কাজে অভ্যস্ত হইয়া যাওয়া অনেক মানুষের মত, বেড়াইতে গিয়া দীর্ঘ সময় থাকিতে হইলেই বা অসুবিধা কী, প্রযুক্তি ও আন্তর্জাল সহায়ে সেইখানে বসিয়াও কাজ করা যাইবে!
কী হইবে, কত দূর হইবে আর কী হইবে না, এখনই বলা যাইতেছে না। অতিমারি এখনও রহিয়াছে, ভ্যাকসিনের আশা উজ্জ্বলতর হইলেও হাতে আসিতে দেরি। কিন্তু অনেক কিছুর মতোই ভ্রমণ, পর্যটন বা মূলগত ভাবে ছুটি উদ্যাপনকেই যে কোভিড পাল্টাইয়া দিল, তাহা লইয়া সন্দেহ নাই। বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, মানুষ এই বার দূরে নহে, নিকটে তাকাইবে, সংখ্যার নিরিখে কম কিন্তু সময়ের হিসাবে দীর্ঘ ছুটি যাপন করিবে। সেই অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রের চরিত্র ও কার্যরীতিও পাল্টাইবার সম্ভাবনা। প্রযুক্তি-ব্যবহারে ঘর হইতেই কাজ হইতেছে, কেবল নিজের ঘর নহে, সমুচ্চ কাঞ্চনজঙ্ঘা বা সুনীল আরব সাগরের শোভা দেখিতে দেখিতে হোটেলের মনোরম কক্ষে বসিয়া— আগামী বৎসর এহেন দৃশ্যের সহিত নব পরিচয়ে সম্ভবত বিস্ময়োদ্রেক হইবে না।