১৯৯০-এর দশকে ভারতে যে আর্থিক সংস্কার হয়েছিল, তার একটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল কৃষিক্ষেত্রে— এই ক্ষেত্রটি থেকে অর্থনীতির নজর সরে গিয়েছিল নির্মাণ বা তথ্যপ্রযুক্তির মতো আধুনিক, গতিশীল ক্ষেত্রের দিকে। তিন দশক পেরিয়ে এসে, অতিমারি আবার আমাদের কৃষির কথা ভাবতে বাধ্য করল। অতিমারির ধাক্কায় যে আর্থিক মন্দা তৈরি হল, তার প্রভাববলয়ের বাইরে রইল শুধু কৃষি। ফলে ফের আলোচনা আরম্ভ হয়েছে যে, কৃষিই কি ভারতকে আর্থিক পুনরুত্থান ও বৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারে?
সাধারণ মানুষের চোখে অবশ্য কৃষির গুরুত্ব তর্কাতীত ভাবে স্পষ্ট হয়ে গেল গত বছরের লকডাউনের সময়। প্রথম বার লকডাউন ঘোষণার পরই শহর থেকে গ্রামের অভিমুখে মানুষের ঢল নামল। পায়ে হেঁটে, অথবা যে কোনও একটা যানবাহনের ব্যবস্থা করে মানুষ গ্রামে ফেরার চেষ্টা করলেন। অবস্থাপন্ন বহু ভারতীয়ই এই ঘটনায় খুব অবাক হয়েছিলেন— তাঁরা বুঝতেই পারেননি, কেন এত মানুষ এই ভাবে স্বাস্থ্যের ও জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, গ্রামে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সাংবাদিকরা এমন বহু পরিযায়ী মানুষকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, কেন তাঁরা গ্রামে ফেরার চেষ্টা করছেন। সবাই একটাই উত্তর দিয়েছিলেন— তাঁরা বিশ্বাস করেন, গ্রামে ফিরতে পারলে কৃষিই তাঁদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। তাঁদের কাছে কৃষি একটা অসরকারি ‘সোশ্যাল সেফটি-নেট’ বা সামাজিক সুরক্ষা জালের মতো, বিশেষত এই সঙ্কটের সময়ে।
দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে কৃষি যে সত্যিই একটা সুরক্ষা জালের মতো কাজ করে, এই কথাটা কৃষি সংস্কার বিষয়ক তর্কে তেমন শোনা যায় না। সেই তর্কের মূল আলোচ্য হল কৃষি থেকে কৃষকের নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা করা। কাজেই, তর্কটা শেষ অবধি এসে দাঁড়ায় এই তর্কে যে, কৃষিতে যদি সংস্কার হয়— এবং সেই সংস্কারের হাত ধরে কৃষির যদি আরও বাণিজ্যিকীকরণ হয়— তবে কি তা কৃষকের আয়বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে? যে হেতু সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নটা আলোচনার বাইরেই থেকে যায়, তাই এই প্রশ্নটাও ওঠে না যে, কৃষির যদি আরও বাণিজ্যিকীকরণ হয়, তবে কি তা সঙ্কটের সময়ে সুরক্ষা জাল হিসেবে কাজ করতে পারবে?
যে দেশের অর্থব্যবস্থা বাজারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বৃদ্ধির পথে হাঁটতে মনস্থ করেছে, সে দেশে কেন সামাজিক সুরক্ষা জাল থাকা অতি প্রয়োজনীয়, সেটা স্পষ্ট ভাবে বোঝা দরকার। বাজার দীর্ঘমেয়াদে তুলনায় বেশি হারে বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে, এ কথা সত্যি। কিন্তু, বাজার ব্যবস্থা যে বিভিন্ন রকম ধাক্কায় কাবু হয়ে যেতে পারে, সেই কথাটাও একই রকম সত্যি। গরিব ও বিভিন্ন ভাবে বিপন্ন মানুষের হাতে সঙ্কটের সময়ের জন্য যথেষ্ট টাকা জমানো থাকে না। কাজেই, বাজার ব্যবস্থা কোনও একটি ধাক্কা খেলে তার আঁচ সবচেয়ে বেশি পড়ে এই জনগোষ্ঠীর উপর— তাঁদের স্বাস্থ্য বিপন্ন হয়, এমনকি প্রাণসংশয়ও হয়। যে দেশ বাজার-নির্ভর বৃদ্ধির পথে হাঁটছে, আদর্শ পরিস্থিতিতে সেই দেশে একটি সরকারি সামাজিক সুরক্ষা জালের পরিকাঠামোও থাকা দরকার, যাতে কোনও সঙ্কট উপস্থিত হলে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয়। এই অতিমারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থব্যবস্থা হয়ে উঠলেও ভারতে তেমন কোনও সামাজিক সুরক্ষার পরিকাঠামো নেই।
পাকাপোক্ত রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে গরিব মানুষকে নির্ভর করতে হয় গোষ্ঠী-ভিত্তিক নিরাপত্তার উপর। ভারতের ছোট-বড় শহরে যাঁরা খেটে খান, ছোটখাটো চাকরি করেন, তাঁদের একটা বিরাট অংশের এখনও গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রয়েছে। এই মানুষগুলোর কাছে এই সম্পর্কটাই সামাজিক নিরাপত্তা। তাঁরা জানেন, শহরে বিপদে পড়লে গ্রাম বাঁচাবে। হঠাৎ করে শহরের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেলে, কৃষি এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র থেকে যে আয় হয়, সেটাই রক্ষা করবে। যে সব মানুষের গ্রামের সঙ্গে পারিবারিক সূত্রটি ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, শহরে হঠাৎ আর্থিক বিপদ এলে তাঁদের বাঁচার একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায় অসংগঠিত খুচরো বিপণন— সোজা বাংলায় বললে, রাস্তার ধারে আনাজ-ফলমূল নিয়ে বিক্রি করতে বসে পড়া।
জো স্টাডওয়েল তাঁর বই হাউ এশিয়া ওয়ার্কস-এ অন্যান্য দেশে এই একই পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন প্রথম পেট্রলিয়াম-সঙ্কট চলছে, তখন তাইওয়ানের শহরাঞ্চলে কারখানায় কর্মরত দুই লক্ষেরও বেশি শ্রমিক ফিরে গিয়েছিলেন গ্রামে, চাষবাস করতে। চিনেও যখন অর্থব্যবস্থা ঝিমোয়, তখন অনেকেই শহর থেকে গ্রামে ফিরে যান। অন্য দিকে, স্টাডওয়াল দেখিয়েছেন, অষ্টাদশ শতকের ব্রিটেন থেকে সাম্প্রতিক কালের ফিলিপিন্স— যেখানেই কৃষিক্ষেত্র বেশি সংগঠিত, তুলনায় বড় মাপের চাষ হয়, সেখানেই শহরের অর্থব্যবস্থা ধাক্কা খেলে ‘মাইলের পর মাইল জুড়ে হতদরিদ্র মানুষের বস্তি তৈরি হয়।’
দক্ষিণ আফ্রিকা এই প্রবণতার আর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। সে দেশে দরিদ্র, বিপন্ন মানুষের সংখ্যা বিপুল। কিন্তু, দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষির নিয়ন্ত্রণ কতিপয় বড় সংস্থা ও খেতমালিকের হাতে। তার ফলে, সে দেশে কৃষি একটি অসরকারি সামাজিক সুরক্ষা জাল হিসেবে কাজ করতে পারে না। তার একটি প্রতিক্রিয়া হল, দক্ষিণ আফ্রিকার শহরগুলিতে অপরাধপ্রবণতা ভয়ঙ্কর।
ভারতের ক্ষেত্রে এই কথাগুলোর তাৎপর্য তবে কী? বিশেষত, ভারতের কৃষিনীতির ক্ষেত্রে? এখন যে কৃষি আইন নিয়ে বিক্ষোভ চলছে, তার অভিমুখ কৃষিকে আরও বেশি সংগঠিত করার দিকে। এখন কৃষি বিপণনের ব্যবস্থাটি আড়তদাররা নিয়ন্ত্রণ করেন। নতুন আইন কৃষি বিপণনকে আরও বেশি কর্পোরেট, আরও সংগঠিত করে তুলতে চাইছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে ভারত যে বাজারমুখী আর্থিক নীতি অনুসরণ করে চলেছে, তাতে এই পরিবর্তনটা অনিবার্যই ছিল। কৃষিতে যত বেশি কর্পোরেট সংস্থা উৎপন্ন ফসলের ক্রেতা হিসেবে প্রবেশ করবে, কৃষি যত বেশি কর্পোরেটাইজ়ড হবে, কৃষকদেরও জোত একত্র করতেই হবে, তা ছাড়া উপায় থাকবে না। কারণ, কর্পোরেট ক্রেতা অনেক ছোট চাষির চেয়ে সীমিত সংখ্যক বড় জোতের অধিকারীদের সঙ্গে লেনদেন করতেই পছন্দ করবে।
ছোট জোতকে একত্র করে বড় জোত তৈরি করার পিছনে যুক্তি আছে। তাতে কর্পোরেট ক্রেতারও লাভ, কৃষক-বিক্রেতারও লাভ। বড় জোতের অধিকারীদের সঙ্গে লেনদেন করলে কর্পোরেট সংস্থার ফসল কেনার খরচ কমবে। অন্য দিকে, এই বড় সংস্থার সঙ্গে দরকষাকষি করার জন্যও কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ হতেই হবে। কৃষি জোতের গড় মাপ অনেক রকম পথে বাড়তে পারে, এবং তা বাড়বেও। মাঝারি মেয়াদে দেখা যাবে, আরও অনেক পরিবার কৃষি থেকে বেরিয়ে অন্য কাজে নিযুক্ত হচ্ছে, এবং কৃষি হয়ে উঠছে অনেক বেশি পুঁজি ও প্রযুক্তি-নিবিড়। এর অনিবার্য ফল হল, তখন কেউ অন্য কোথাও বিপদে পড়ে কৃষিতে আশ্রয় চাইলেই তা পাবেন না— কারণ, কৃষিতে প্রবেশ করা তখন আর এখনকার মতো সহজ হবে না। ফলে, এখন কৃষি যেমন সামাজিক সুরক্ষা জালের কাজ করে, তখন আর তা করবে না।
কিন্তু, তা বলে কৃষিক্ষেত্রে বাজারমুখী সংস্কার থেকে পিছিয়ে আসার যুক্তি নেই। আমাদের শুধু স্বীকার করতে হবে যে, যদি রাষ্ট্রীয় স্তরে যথেষ্ট মাপের সামাজিক সুরক্ষা জালের ব্যবস্থা না করা হয়, তা হলে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের প্রকল্পটি সামাজিক ভাবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হবে। বিপন্ন মানুষকে চিহ্নিত করা, এবং যথাসময়ে তাঁদের কাছে সাহায্য নিয়ে পৌঁছে যাওয়ার কাজটা সহজ নয়— প্রশাসনিক কাঠামোকে অনেক বেশি তৎপর ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
আর, যদি আমরা সামাজিক সুরক্ষা জালের ব্যবস্থা না করেই কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের পথে হাঁটি, তবে পরবর্তী আর্থিক সঙ্কট শহরাঞ্চলে অন্য একটি মানবিক সঙ্কটেরও জন্ম দেবে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসি, দিল্লি