ছবি: পিটিআই।
লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট— বাক্যটি অতিব্যবহারে জীর্ণ হইয়াছে। কিন্তু পুরাতন বলিয়া তাহাকে তুচ্ছ করিবার উপায় নাই। সে-কথা জানিতেন বলিয়াই রবীন্দ্রনাথ মিনতি করিয়াছিলেন, ‘যাবার বেলা শেষ কথাটি যাও বলে’ এবং পরের লাইনেই সেই মিনতির উদ্দেশ্যটি সাফ সাফ জানাইয়া দিয়াছিলেন, ‘কোনখানে যে মন লুকানো দাও বলে’। দয়িতার মন অপেক্ষা অনেক বেশি দুর্জ্ঞেয় মোদী সরকার তথা তাহার হৃদিস্থিত সঙ্ঘ পরিবারের ‘মন কি বাত’— কিছু তার দেখি আভা, কিছু পাই অনুমানে। সম্প্রতি ঘোষিত জাতীয় শিক্ষা নীতির কথামালাতেও তেমন কিছু অনুমানের অবকাশ রহিয়াছে। যেমন ধরা যাক ভূমিকার অন্তর্গত ‘এই নীতির মূল সূত্র’ (প্রিন্সিপলস অব দিস পলিসি) নামক অংশটির দীর্ঘ অনুচ্ছেদের (০.১৩) শেষ কথাটি: শিক্ষা একটি জনপরিষেবা, তাহা বাণিজ্য করিবার বিষয় নহে, মুনাফার উৎস নহে, সুতরাং সমস্ত নাগরিককে উচ্চমানের শিক্ষার সুযোগ দিবার জন্য সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ জরুরি, তাহার সঙ্গে সঙ্গে ‘যথার্থ জনহিতৈষী বেসরকারি (উদ্যোগের) ভূমিকাকে উৎসাহ এবং সুযোগ দেওয়া হইবে’। জনহিতৈষা (ফিলানথ্রপি) অতি উৎকৃষ্ট বস্তু। বহু দেশেই বিবিধ জনহিতৈষী প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং ব্যক্তি শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিয়াছে। ভারতেও। জাতীয় শিক্ষা নীতির ‘মূল’ সূত্রাবলির শেষ সূত্র হিসাবে জনহিতৈষার এই স্বীকৃতিকে অযৌক্তিক বলিবার জো নাই।
কিন্তু সূত্র কখনওই নিরালম্ব নহে। সরকারি নীতিকে শাসকের চিন্তাধারা ও আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করাই বিধেয়। এবং সেই কারণেই শিক্ষা বিস্তারে ‘জনহিতৈষী’ উদ্যোগের প্রতি মোদী সরকারের এই বিশেষ আনুকূল্য ভাবাইয়া তোলে। আরএসএস বরাবর নিজেকে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবেই চিহ্নিত করিয়া আসিয়াছে। ক্ষমতার রাজনীতি হইতে ‘দূরে’ থাকিয়া তাহার উপর প্রবল প্রভাব বিস্তারে এই সংগঠনের কৃতি ও পারঙ্গমতার বৃত্তান্ত বহুচর্চিত। সেই প্রসঙ্গ অন্যত্র। কিন্তু ‘সাংস্কৃতিক’ পরিসরটিই ক্ষমতার রাজনীতির উৎকৃষ্ট চারণভূমি। বস্তুত, সংস্কৃতির ধারণা ও বিষয়বস্তুকে রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রসারে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, আরএসএস এবং তাহার অনুগামী তথা সহগামী সঙ্ঘ পরিবারের বিবিধ শাখাপ্রশাখার কার্যকলাপ তাহার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। শিক্ষার পরিসরটিতে এই প্রভাব প্রতিপত্তি সর্বাধিক প্রকট। এক দিকে পাঠ্যসূচির পরিবর্তন, অন্য দিকে সমস্ত স্তরে, বিশেষত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে সঙ্ঘের ক্রমবর্ধমান দাপট— গৈরিকীকরণ চলিতেছে দুর্বার গতিতে।
কিন্তু তাহা প্রভাব বিস্তারের একটি দিক। অন্য দিকটি গূঢ়তর। সঙ্ঘ পরিবারের বিবিধ ‘জনহিতৈষী’ সংগঠন সরাসরি শিক্ষার পরিসরে সক্রিয়। অনগ্রসর অঞ্চলে, সামাজিক ভাবে পশ্চাৎপদ বর্গের মানুষের মধ্যে তাহাদের সক্রিয়তা চলিয়া আসিতেছে দীর্ঘ কাল— ‘ফিলানথ্রপি’র মোড়কে ‘অনুন্নত’ সমাজে ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারের ঔপনিবেশিক মডেলটির ছায়া এই ক্ষেত্রে অতীব স্পষ্ট। পাশাপাশি, ক্রমে উচ্চবর্গের নাগরিক সমাজেও সঙ্ঘ-শিক্ষার প্রসার বাড়িতেছে। এই প্রক্রিয়াটিকে কি অতঃপর জাতীয় শিক্ষা নীতির রাষ্ট্রীয় সিলমোহর দেওয়া হইবে? লক্ষণীয়, নীতিপত্রে প্রাথমিক প্রস্তাবনার সূত্রটি ফিরিয়া আসিয়াছে উচ্চশিক্ষার অধ্যায়ে। সেখানে, শিক্ষা পরিকাঠামোর অর্থ সংস্থানের অন্যতম উপায় হিসাবে জনহিতৈষী উদ্যোগ এবং প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় জোর দেওয়া হইয়াছে। অর্থাৎ, আশঙ্কার কারণ আছে, শিক্ষার প্রসারে জনহিতৈষী সামাজিক উদ্যোগের আবরণে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের আটঘাট বাঁধা হইতেছে। এখনই নিশ্চিত করিয়া কিছু বলা কঠিন, বলা উচিতও নহে। কিন্তু সংশয় থাকিয়াই যায়। শেষ কথা হিসাবে বলিতেই হয়: কিছু তার বুঝি না বা।