সূচনা: মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে উদ্ধব ঠাকরে। মুম্বই, ২৮ নভেম্বর ২০১৯। পিটিআই
অঘাড়ী’! সম্প্রতি অতি ঘূর্ণায়মান মহারাষ্ট্র রাজনীতির ‘হৃদয় মথিয়া’ উঠে আসা এই তিন-অক্ষরি মরাঠি শব্দটি এখন সারা দেশের লোকের মুখে মুখে ফিরছে, যার সরল মর্মার্থ হল ‘সম্মুখভাগ’ বা ‘অগ্রগামী অংশ’। আর রাজনৈতিক অর্থ ‘ফ্রন্ট’, বা সোজা ভাবে বললে, রাজনৈতিক ‘জোট’। মহারাষ্ট্র বরাবরই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ‘মরাঠি মানুষ’-এর স্বতন্ত্র অস্মিতার ওপর জোর দিয়েছে। তাই ইংরেজি ‘অ্যালায়েন্স’ (যেমন, কেন্দ্রের শাসক জোট ‘ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ বা ‘এনডিএ’) বা ‘ফ্রন্ট’ (যেমন, ‘বামফ্রন্ট’) কথাটি ব্যবহার না করে, মরাঠি লব্জে নবগঠিত জোটকে ‘অঘাড়ী’ বলা হচ্ছে। পোশাকি নাম ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ অঘাড়ী’। এক দিকে হিন্দুত্ব ও মরাঠি স্বাভিমানের মিশেলে তৈরি কট্টর মতাদর্শে বিশ্বাসী, প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের শিবসেনার সঙ্গে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী কংগ্রেসের জোটের সম্ভাবনা কয়েক দিন আগেও অলীক মনে হত। এখন তা-ই বাস্তব। রাজনীতি যে শেষ বিচারে ‘সম্ভাব্যতার শিল্প’, এই ঘটনা তা ফের প্রমাণ করল। তবুও, ঢোক গিলে নিজেদের মতাদর্শগত পরিচয়ের কথাও ভাবতে হয়। তাই ‘মহারাষ্ট্র’ আর ‘অঘাড়ী’র মাঝখানে ‘বিকাশ’ নামক আপাত নিরপেক্ষ কথাটি রাখতে হয়।
মহারাষ্ট্রের এই অঘটনের রাজনীতি আমাদের কয়েকটা জরুরি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাল। এর মধ্যে রাজ্যপালের চরম একদেশদর্শী ভূমিকা, কংগ্রেসের জোটসঙ্গী হওয়া, এনসিপি-র সর্বাধিনায়ক শরদ পওয়ারের ভ্রাতুষ্পুত্র অজিত পওয়ারের ক্ষণে ক্ষণে রংবদল, বিজেপি সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা, জোটে যোগ দেওয়ায় কংগ্রেসের দোলাচল, নতুন জোটে কোন দলের ক’জন মন্ত্রী হবেন, কিংবা শেষমেশ উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বে গঠিত এই ‘অঘাড়ী সরকার’ কত দিন টিকবে— এ সব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আরও দু’একটি গভীর বিষয়ও ভাবনার দাবি করে, যা সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতির একটি ক্রমবর্ধমান ‘অসুখ’-এর লক্ষণ বুঝতেও সাহায্য করবে।
ভারতীয় দলব্যবস্থার হালহকিকত নিয়ে যাঁরা কিছুমাত্র খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্য বহন করা জাতীয় কংগ্রেসই দেশের সর্বময় শাসক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকে (তখন লোকসভা ও বিধানসভায় একই সময়ে ভোট হত) ১৯৮০-র দশকের শেষ অবধি, প্রায় চার দশক কংগ্রেস কেন্দ্রে ও অধিকাংশ রাজ্যে দাপিয়ে রাজত্ব করেছে। এর মধ্যে ১৯৬৭ অবধি (কেরলের স্বল্পকালীন কমিউনিস্ট শাসন ছাড়া) সব রাজ্যগুলিতেও ছিল কংগ্রেস সরকার, যা প্রথম কিছুটা ধাক্কা খায় চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে। এর পর ১৯৭০-এর গোড়া থেকে ১৯৭৭ সালে ‘জরুরি অবস্থা’-পরবর্তী লোকসভা অবধি ফের সর্বত্র কংগ্রেস। পরের পৌনে তিন বছর কেন্দ্রে ও বহু রাজ্যে জনতা পার্টির সরকার থাকলেও, আশির দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে ও বহু রাজ্যে কংগ্রেস আবার স্বমহিমায়। নব্বইয়ের দশক থেকে কংগ্রেসের একাধিপত্য কমতে থাকে ও কেন্দ্রে জোট রাজনীতির গুরুত্ব বাড়তে থাকে, যা নানা অবতারে চলতে চলতে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে, ফের কেন্দ্রে জোট সরকারের মধ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের (বিজেপির) শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ২০১৯-এ বিপুলতর সংখ্যায় শাসক জোট এনডিএ-তে বিজেপির আধিপত্য কায়েম হয়। অস্যার্থ, ভারতে স্বাধীনতার পর কংগ্রেস তার সর্বব্যাপী অবস্থা থেকে ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ ছোট হয়েছে। অনেকটা ভারতব্যাপী মুঘল সাম্রাজ্যের ছোট হওয়ার মতোই। হয়তো বাহাদুর শাহ জাফরের মতো লাল কেল্লাটুকু তার ক্ষমতার সীমানা নয়, কিন্তু পড়ন্ত রাজবংশের মতো, নিজ অতীত গরিমার ব্যাপারে অতি সংবেদনশীলতা ও তার বিপরীতে ক্ষমতার পরিধি ক্রমশ ছোট হয়ে আসা— এই দ্বিমুখী টানাপড়েনেই তার বর্তমান অবস্থান।
এর ঠিক উল্টো পথে বিজেপির যাত্রা। ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস বড় থেকে যত ছোট হয়েছে, ততই বিজেপি ছোট থেকে বড় হয়েছে। পঞ্চাশের দশকের সাবেক জনসঙ্ঘ ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল অবধি জনতা পার্টিতে মিশে, ফের ১৯৮০ সাল থেকে বিজেপি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইন্দিরা গাঁধীর হত্যার অব্যবহিত পরে ১৯৮৪-র ভোটে সহানুভূতির ঢেউয়ে ভেসে কংগ্রেস যখন লোকসভায় ৪০৩, সদ্যগঠিত বিজেপির তখন মাত্র দুই সাংসদ! সেই নামমাত্র আসন সংখ্যা থেকে মুখ্যত হিন্দুত্বের আজেন্ডা (যেমন, রথযাত্রা, বাবরি মসজিদ ভাঙা ইত্যাদি) সামনে রেখে বিজেপি উত্তরোত্তর কেবল আসন বাড়ায়নি, রাজ্য পর্যায়েও তার প্রভাব বাড়াতে শুরু করেছে আঞ্চলিক দলগুলোর হাত ধরে। কেন্দ্রে জোটসঙ্গী জোগাড় করা দুরূহ হলেও, রাজ্যস্তরে কিছু বন্ধু জুটেই গেল। এর পাশে, এখনকার রাজনীতিতে টিকে থাকতে গেলে যে ‘জোট’ই ভরসা, এ কথা বুঝে উঠতে কংগ্রেসকে পচমঢ়ী-র ‘চিন্তন শিবির’ (১৯৯৮) অবধি অপেক্ষা করতে হল!
বিজেপি তখন মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, পঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দল (এসএডি), বিহারে নীতীশ কুমার-জর্জ ফার্নান্ডেজ-এর সমতা পার্টি (এখন যা জেডিইউ), পশ্চিমবঙ্গে সদ্যগঠিত তৃণমূল কংগ্রেস, অন্ধ্রে চন্দ্রবাবু নায়ডু-র টিডিপি, তামিলনাড়ুতে কখনও ডিএমকে কখনও এডিএমকে’কে সঙ্গী করে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। যদিও বেশির ভাগ দলের সঙ্গেই বিজেপির রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনও মিল ছিল না। মুখ্যত নিজ নিজ রাজ্যে কোনও ‘সাধারণ’ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এই সব জোট গড়ে উঠেছিল। যেমন, বিহারে লালুপ্রসাদের আরজেডি বা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট। রাজ্যস্তরে জোট করতে গিয়ে বিজেপি বেশির ভাগ সময়ে আঞ্চলিক দলকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। পঞ্জাবে এসএডি, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, বিহারে সমতা পার্টি ইত্যাদি তারই উদাহরণ। নিজে সর্বভারতীয় দল হয়েও মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে আঞ্চলিক দলের অগ্রাধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। যেমন, ১৯৯৫ সালে মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শিবসেনার মনোহর জোশীকেই সমর্থন করেছে। একাই সব গিলে খেতে চায়নি। ফলে আঞ্চলিক দলগুলো ‘পুরনো’ বিজেপির কাছে মর্যাদা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অটলবিহারী বাজপেয়ী তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা’কে দেখতে স্বয়ং তাঁর বাড়ি পৌঁছেছিলেন। এই মর্যাদা আর বিশ্বাস, বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি ও আঞ্চলিক দলের সম্পর্ককে মজবুত করেছে।
২০১৪’র লোকসভা ভোটের আগে, আডবাণী-বাজপেয়ীর ঐতিহ্যকে অতীতের গুমঘরে পাঠিয়ে, মোদী-শাহ জুটির সর্বময় কর্তৃত্বে যে ‘নতুন’ বিজেপির জন্ম হল, তা কেবল যে কোনও উপায়ে ক্ষমতা দখল ও দলীয় স্বার্থরক্ষাকেই একমাত্র মোক্ষ মনে করল। পুরনো আমলের নেতারা রাজ্যের জোটসঙ্গীদের যে মর্যাদা-দানের সংস্কৃতি শুরু করেছিলেন, তার আবরণ খসে পড়ল। একদা ‘সম্পদ’ ভাবা জোটসঙ্গীরা সহসা বোঝা হয়ে দাঁড়াল। কী ভাবে জোটসঙ্গীর রাজনৈতিক ‘জমি’ দখল করে একক ভাবে ক্ষমতা দখল করা যায়, তা-ই হয়ে উঠল ‘নতুন’ বিজেপির সাফল্যের রোডম্যাপ। পারস্পরিক বিশ্বাসের বাতাবরণ গেল চুলোয়। ফলত, আঞ্চলিক পার্টিগুলি বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ার ক্ষেত্রে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। অন্ধ্রে চন্দ্রবাবু, বিহারে কিছু সময়ের জন্য নীতীশ কুমার, বা মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক বিগড়োতে লাগল, তাঁদের আত্মসম্মানে ‘আঘাত’ লাগল।
এ বারও গোড়া থেকে শিবসেনা বলে এসেছে যে বিজেপি (পড়ুন অমিত শাহ) তাদের নির্বাচনের সময় অর্ধকালীন মেয়াদে ক্ষমতা ভাগাভাগির যে ‘প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিল, তা থেকে ‘সরে এসেছে’। এই দাবির সত্য-মিথ্যা নিরূপণ শিবেরও অসাধ্যি। কিন্তু গত মাসখানেক ধরে চলা মহা-নাট্য, যার শেষের কয়েক দিনের টিভি সম্প্রচার জনপ্রিয় টেলি-সিরিয়ালগুলোর ‘টিআরপি’কেও ছাড়িয়ে গিয়েছে, তা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল: ক্ষমতা ধরে রাখার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে তার সবচেয়ে পুরনো জোটসঙ্গীর সম্পর্কটা কোন তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে! ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ গড়ার ডাক দিয়ে কি বিজেপি আসলে নিজেই এক অসহিষ্ণু, ক্ষমতালিপ্সু, অহঙ্কারী অতীতের ‘কংগ্রেস’-তুল্য সর্বময় দল হয়ে উঠতে চাইছে? মহারাষ্ট্রে ‘অঘাড়ী’ কিন্তু এই বিজয়শঙ্খের একমাত্রিক সুরে ছন্দপতন ঘটিয়েছে। তা যত ক্ষণস্থায়ী হোক না কেন!
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়