এ দেশেরই এক মনীষী বলিয়াছিলেন, অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে নয়। বক্তার নাম, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। তাঁহার প্রায় কোনও কথাই তাঁহার দেশের মানুষ শোনে নাই, সব কথার মধ্যে বিশেষ করিয়া এই কথাটি বোধহয় একেবারে অবোধ্য ঠেকিয়াছে। তাই সর্বত্র অপরাধকে ছাড়াইয়া অপরাধীই আপাতত সকলের ঘৃণার পাত্র, এমনকী বহু ক্ষেত্রে অপরাধীর সহিত কোনও না কোনও পরিচয়ের সূত্রে আবদ্ধ, এক গোত্রভুক্ত, সকল ব্যক্তিই ঘৃণ্য হইয়া যান। এমন সামান্যীকরণ যে আসলে ঘোর অপরাধ, সে-কথা বুঝিবার সাধ্য সকলের নাই। তাই ধর্মপরিচয় বা জাতপরিচয়ের সূত্র ধরিয়া ‘বিশেষ’ হইতে ‘সামান্যে’ অসহিষ্ণুতার উত্তরণ এ দেশে অতিপরিচিত ঘটনা। কোনও জাত বা ধর্মের কোনও মানুষ ভুল বা মন্দ কাজ করিয়াছে, সুতরাং গোটা জাত বা ধর্মসম্প্রদায়কে ধরিয়া পিটুনি দাও: এই মানসিকতায় ভারতবর্ষ অভ্যস্ত হইয়া়েছ। আপাতত এই সম্মেলক ভিত্তিতে অসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে নূতন সংযোজন: লিঙ্গপরিচয়। কোনও পুরুষ অন্যায় করিয়াছে, তাই পুরুষজাতিকে বয়কট করো। এই হইল সেই নূতন সংযোজন। কলিকাতার সমাজে এই মানসিকতারই এখন প্রবল প্রকাশ।
মেয়েদের বিদ্যালয়ে কোনও পুরুষ শিক্ষক বা কর্মী অশালীন ও অনৈতিক কাজের জন্য অভিযুক্ত হইলে তাঁহার যথাবিধি শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু এই ঘটনা হইতে যদি সিদ্ধান্ত হয়— সমস্ত পুরুষ শিক্ষক কিংবা স্কুল-কর্মীই সন্দেহভাজন, সুতরাং তাঁহাদের সকলকে বিদ্যালয় চত্বর হইতে নির্বাসন দেওয়া উচিত, তবে তর্কশাস্ত্রের নিয়ম লঙ্ঘিত হয়, নীতিশাস্ত্রের নিয়ম আরওই অধিক লঙ্ঘিত হয়। এক জন বা কয়েক জন অপরাধী ব্যক্তির অপরাধ হইতে এই অনুমান আদৌ সংগত নয় কোনও পুরুষই ছোট মেয়েদের কাছাকাছি থাকিবার অধিকারী নহেন। এই ভাবনার মধ্যে পুরুষদের প্রতি ঘোর অসম্মান আছে, যে অসম্মান সামাজিক সুস্থতাকে বিঘ্নিত করিতে সক্ষম। ছোট মেয়েদের মধ্যে এই ভাবনা ভুল মূল্যবোধ তৈরি করিতে পারে, তীব্র নিরাপত্তার অভাবও তৈরি করিতে পারে। অপরাধী সকলে হন না, কেহ কেহ হন। স্কুলের কোনও পুরুষকর্মী অন্যায়কারী হইতে পারেন, কিন্তু বহু কর্মী যে আবার ছাত্রীদের প্রতি আন্তরিক বাৎসল্য অনুভব করেন, তাহাদের যত্নে রাখিতে চান, এই সত্যটি ছাত্রীদের ভুলাইয়া দিলে বড় হইয়াও তাহারা বাহিরের সমাজে পা রাখিতে ভয়ে কাঁপিবে।
আশ্চর্য যে অভিভাবকরাই নিজেদের কন্যাদের এই সত্যটি দেখিতে দিতে চাহেন না, বরং তাহাদের মধ্যে ‘পুরুষ দেখিলেই সাবধান’ জাতীয় একটি গভীর মৌলবাদ ঢুকাইয়া দিতে প্রবৃত্ত। এই বিপজ্জনক প্রবণতা এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। বরং বিদ্যালয়গুলি কীভাবে আরও সতর্ক হইতে পারে, তাহা ভাবা যাক। আশ্বাসের কথা যে সম্প্রতি কলিকাতার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ একত্র হইয়া আলোচনায় বসিতে চলিয়াছে। এক নামী স্কুলের ডিরেক্টর মনে করাইয়া দিয়াছেন, যৌন হেনস্তা কেবল মেয়েদের স্কুলে নয়, ছেলেদের স্কুলেও হইতে পারে। ইহা ছেলে বনাম মেয়ের প্রশ্ন নয়, ছেলে ও মেয়ে সকলের একত্র সুস্থ সহাবস্থানের প্রশ্ন। শিশুরা যেন ভুলিয়া না যায়, সমাজ একটি একত্রতার পরিসর। আলাদা আলাদা কোটরে আলাদা আলাদা পরিচয়ের বসবাসের বন্দোবস্ত নহে।