Netaji Subhas Chandra Bose

সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে একাসনে?

অথচ এই নেতাকে হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসেবে প্রতিস্থাপনের বেপরোয়া চেষ্টা চলছে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও সাভারকরের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে নেতাজিকে একাসনে বসানোর চেষ্টা চলছে।

Advertisement

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২১ ০৬:১৬
Share:

সুভাষচন্দ্রের সারা জীবনই তীব্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত। এক জন হিন্দু হিসেবে রামকৃষ্ণদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন তিনি। আর রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে শিষ্য ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতপথের প্রধান এক দিশারি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের। চিত্তরঞ্জনের মতোই নেতাজি সুভাষের জীবনে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের স্থান ছিল না কোনও। সুভাষ লিখেছেন, “ভারতের হিন্দু জননায়কদের মধ্যে দেশবন্ধুর মতো ইসলামের এত বড় বন্ধু আর কেহ ছিলেন বলিয়া আমার মনে হয় না। তিনি হিন্দুধর্মকে এত ভালবাসিতেন যে তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন, অথচ তাঁর মনের মধ্যে গোঁড়ামি আদৌ ছিল না। আমি জিজ্ঞাসা করি, কয়জন হিন্দু নায়ক বুকে হাত দিয়া বলিতে পারেন তাঁহারা মুসলমানকে আদৌ ঘৃণা করেন না?”

Advertisement

অথচ এই নেতাকে হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসেবে প্রতিস্থাপনের বেপরোয়া চেষ্টা চলছে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও সাভারকরের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে নেতাজিকে একাসনে বসানোর চেষ্টা চলছে।

ইতিহাস কী বলে? শ্যামাপ্রসাদের জনসঙ্ঘ-পূর্ববর্তী হিন্দু মহাসভার মিটিং ভেঙে দেয় সুভাষের ফরওয়ার্ড ব্লকের বাহিনী। শ্যামাপ্রসাদের নিজের লেখা লিভস ফ্রম আ ডায়েরি-তেও তার সাক্ষ্য। সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতিত্বকালেই কংগ্রেস দল কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার দ্বৈত সদস্যপদ নিষিদ্ধ করেছিল। অর্থাৎ, এক সংগঠনের সদস্য থাকলে অন্যটির সদস্য থাকা চলবে না। মুসলিম লীগের পক্ষেও সেই একই আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ৪ মে ফরওয়ার্ড ব্লকের কাগজে ‘কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন’ শিরোনামে সুভাষ সম্পাদকীয় লেখেন, “হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কোনও সদস্য কংগ্রেসের কোনও নির্বাচনী কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।” এই হিন্দু মহাসভার দুই বিশাল নেতা ছিলেন দামোদর বিনায়ক সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

শুধু শ্যামাপ্রসাদের মিটিং ভেঙে দেওয়াই নয়। সুভাষ বাহিনী আরও বেশি নির্মম ছিল সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি। আরএসএস, জনসঙ্ঘ ও এবিভিপি নেতা বলরাজ মাধোক তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, “সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমর্থকদের বলেছিলেন হিন্দু মহাসভাকে আটকাতে। হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলায় ভয় দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের ফরওয়ার্ড ব্লকের স্বেচ্ছাসেবীরা। তাঁর লোকেরা হিন্দু মহাসভার সভা ভেঙে প্রার্থীদের মারধর করত। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তা অগ্রাহ্য করে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। তিনি কথা বলার সময়ে তাঁর মাথায় একটি পাথর আঘাত করে এবং প্রচুর রক্তপাত হয়।” বিবরণটি সত্য কি না, জানা নেই। সত্য হলেও, এই ঘটনার সঙ্গে নেতৃত্বের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না, এমনই ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু, দুই মতবাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব এই বিবরণ থেকে স্পষ্ট।

সমাজবিজ্ঞানী সুদীপ্ত কবিরাজ সম্প্রতি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীরা সাধারণ অর্থে হিন্দুধর্মের পক্ষে নন— হিন্দুত্বের পক্ষে। হিন্দুধর্ম তো সহস্র বছরের। আর হিন্দুত্ব, একশো বছর আগে সাভারকরের নব আবিষ্কার।” (‘পশ্চিমবঙ্গে মার্ক্সবাদ’, প্রকাশিতব্য)

জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী মহাসভায় সাভারকর থেকে রিলে রেসের ব্যাটন বয়েছেন জনসঙ্ঘ-বিজেপির চালিকাশক্তি আরএসএসের মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর। দুই হিন্দুত্ববাদী নেতাই হিটলারের দর্শন ও কাজকর্মের প্রশস্তি রচনা করেছেন, এবং ত্রিশের দশকের জার্মানিতে ইহুদিদের প্রতি অবর্ণনীয় নিষ্পেষণ, ঘৃণা ও হিংসাকে সমর্থনযোগ্য মডেল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গোলওয়ালকরের নির্দেশেই শ্যামাপ্রসাদ ১৯৫১ সালে মহাসভা ছেড়ে ভারতীয় জনসঙ্ঘ স্থাপন করেন, গাঁধীহত্যার পরবর্তী সময়ে তীব্র জনরোষকে সংসদে সামাল দেওয়ার জন্যে। এই জনসঙ্ঘেরই পরবর্তী রূপ বিজেপি।

সাভারকরের নেতৃত্বে মহাসভার হিন্দুত্ববাদীরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সৈন্যদলকে প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করার কথা শোনা যায়। তুলনায় হয়তো কম শোনা যায় যে, ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বিরোধিতায় শামিল হন শ্যামাপ্রসাদও। ১৯৪২ সালের ২৬ জুলাই শ্যামাপ্রসাদ ব্রিটিশ গভর্নর জন হারবার্টকে চিঠি লেখেন, “কেমন করে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মোকাবিলা করা যায়? এই (বাংলা) প্রদেশের ব্রিটিশ শাসকদের কাজ হল, কংগ্রেসের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দেওয়া। ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকারকে বিশ্বাস করতেই হবে... এই প্রদেশের সুরক্ষারই স্বার্থে।” (সূত্র: এ জি নুরানি, আরএসএস অ্যান্ড দ্য বিজেপি: আ ডিভিশন অব লেবার।)

মনে রাখতে হবে, সেই একই সময়ে বাংলায় হাজার ছেলেমেয়ে ব্রিটিশবিরোধী লড়াই করে প্রাণ দিচ্ছেন, অত্যাচারিত হচ্ছেন, সর্বস্ব ত্যাগ করছেন। নেতাজি সুভাষ তৈরি হচ্ছেন তাঁর মহাসংগ্রামের জন্য। দেশের বাইরে থেকে চলছে তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের পরিকল্পনা, জার্মানি ও জাপানের সহায়তা নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার প্রয়াস। রাসবিহারী বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ। এ সব তো গায়ে-কাঁটা ধরানো ইতিহাস।

আজকের শ্যামাপ্রসাদ ও সাভারকরের সমর্থকদের হাতে সেই ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement