কুঠারের কোপ। ফাইল চিত্র
১৮০৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠন করে জেলা জঙ্গলমহল। নাম থেকেই জঙ্গলের উপস্থিতি প্রতীয়মান।
এই জঙ্গলমহলের স্বাভাবিক বনভূমি গঠিত ছিল শাল, পিয়াশাল, মহুয়া, কেন্দ, ময়না, কর, গামার ইত্যাদি নিয়ে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই বৃহদবৃক্ষের অরণ্যে বাস করত বিভিন্ন বন্যপ্রাণি। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম হান্টারের বাঁকুড়া গেজেট থেকে জানা যায়, সেই সময়ে এই অরণ্যে থাকত বাঘ, ভাল্লুক, হাতি, হায়না, কৃষ্ণসার মৃগ, চৌশিঙ্গা হরিণের মতো প্রাণি। এর কিছু কাল পর ও ম্যালি রচিত ‘‘বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স’’ থেকে জানা যায়, শালতোড়া এবং রাইপুরের জঙ্গলে বাঘ দেখতে পাওয়া যেত। ঝিলিমিলির জঙ্গল ছিল চিতল হরিণের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে বাঁকুড়া শহরের পাটপুরে একটি চিতাবাঘের দেখতে পাওয়ার খবর এখনও মানুষদের মুখে মুখে ফেরে।
আসলে অরণ্যবাসী জনজীবনের প্রত্যেকটি উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে জঙ্গল। পাশাপাশি, জড়িয়ে রয়েছে পশুশিকারও। সম্ভবত অরণ্যবেষ্টিত সমাজে হিংস্র জন্তুকে হত্যা করে বা তাড়িয়ে অরণ্য-আবাস নিরাপদ করে তোলা এবং খাদ্য হিসাবে মাংসের চাহিদা মেটানোর জন্য অরণ্যচারী আদিবাসী জনজীবনে শিকারের প্রবর্তন হয়েছিল। বিক্ষিপ্ত ভাবে ২-৪ বৈশাখ এখনও শিকার উৎসব পালন করেন আদিবাসীরা। এই শিকার ‘দিল্লি’ শিকার নামে পরিচিত। বৈশাখ মাসের প্রথমে শুরু হওয়া এই শিকার উৎসব শেষ হয় বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন অযোধ্যা পাহাড়ে প্রতিপালিত হওয়া অযোধ্যা শিকারের মধ্য দিয়ে।
এই শিকারের উদ্দেশ্য কিন্তু শুধুমাত্র পশু হত্যা নয়। মূল উদ্দেশ্য দূর দূর গ্রাম থেকে আগত লোকজনের মধ্যে নিজেদের সমাজ ব্যবস্থার নিয়মকানুন সম্পর্কে আলোচনা করা ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা। এমনকি, প্রয়োজনে মাঝি, দিশম-মাঝি, দিহরি প্রমুখের উপস্থিতিতে যে কোনও সমস্যার সমাধান করা।
পশুশিকার করে মাংস খেলেই আদিবাসী জনজীবনে পশুপাখির প্রভাব শেষ হয়ে যায় না। পশুপাখির দেহাংশেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁদের জীবনে। যেমন, তাঁদের বিশ্বাস বাত এবং অস্থি-সন্ধির ব্যথা হলে বন্যশূকরের চর্বি দিয়ে মালিশ করলে ব্যথার উপশম হয়। গর্ভাবস্থার জটিলতায়, পেটের ব্যাথার উপশমে খরগোশের ভ্রূণ এবং মাংস ব্যবহৃত হয়। হরিণের চামড়া বিভিন্ন সেখান দ্রব্য তৈরিতে কাজে লাগে। আদিবাসীদের বিশ্বাস হরিণের শিং শিলবাঁটা জল খেলে বুকের ব্যথা সেরে যায়। শিং বাঁশি তৈরিতে কাজে লাগে। চামড়া হাঁপানি উপশমে ব্যবহৃত হয়। খটাশের মাংস দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। পুরুষ গন্ধগোকুলের অণ্ডকোষ মস্তিষ্কের সমস্যায় এবং হার্নিয়া ও হাইড্রোসিল নিরাময়ের কাজে লাগে। কলা-বাদুড়ের হাড় রাতের বেলায় মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে। সজারু কাঁটা থেকে কলম তৈরি হয়। দেহের কোনও অংশের ব্যথা উপশমে ঢ্যামনা সাপের চর্বি ব্যবহৃত হয়। গবাদি পশুর রোগ সারানোর জন্য কচ্ছপের পিঠের খোলের গুঁড়ো খাওয়ানো হয়। লাঙ্গল ধরার পর গরুর কাঁধের ব্যথা সারানোর জন্য গোসাপের চর্বি ব্যবহার করা হয়। গাঁটের ব্যথা উপশমে ব্যবহৃত হয় বড়াসাপের চর্বি।
স্পষ্টত, এই সমস্ত কিছু ব্যবহারের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তবে এ থেকে বোঝা যায়, আদিবাসীরা জঙ্গলকে ভালবাসে। জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। এ দিকে, উচ্চবর্ণের মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই অরণ্য অবলুপ্তির কারণ হিসাবে আদিবাসীদের শিকার উৎসবকে দায়ী করেন। কিন্তু আমার মতে, এই সিদ্ধান্ত প্রকৃত সমস্যার কারণকে সরল করে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
আদিবাসীরা বাঁচার প্রয়োজনে শিকারকে জীবনের অঙ্গ বানিয়েছিল। কিন্তু এই শিকারই ছিল রাজাদের অন্যতম বিনোদনের উপায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের জন্য সম্রাট অশোক বহুবিধ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তার পরে আর কোনও সম্রাট এরূপ সদর্থক পদক্ষেপ করেননি। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বন্যপ্রাণ। সহজে শিকার করা যেত বলে বাঁকুড়া পুরুলিয়া জেলার বিস্তীর্ণ বনভূমি ব্রিটিশ আমলে ছিল বিনোদনের মূল জায়গা। এতদসত্ত্বেও বন্যপ্রাণিদের সংখ্যা এ অঞ্চলে যথেষ্ট ছিল। কমতে শুরু করল যখন হ্রাস পেল স্বাভাবিক বনভূমির পরিমাণ।
অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত জেলা গেজেট থেকে জানা যায়, ১৯০২ সালে বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে বাঁকুড়ার উপর দিয়ে বিস্তৃত হওয়ার পর এই অঞ্চলের জঙ্গলে ব্যাপক বৃক্ষনিধন শুরু হয়। ফলে প্রাকৃতিক বন যা এককালে উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গে প্রায় সমান ছিল তা দক্ষিণবঙ্গে অনেকাংশেই কমে যায়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জঙ্গল কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ করা হতে থাকে। ফলে সংকুচিত হয় অরণ্য এলাকা। এখনও হচ্ছে।
অরণ্য বাঁচানোর অন্যতম ‘উদ্যোগ’ হিসাবে অনেক জায়গায় সরকারের তরফ থেকে বনভূমি পাট্টা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর ফলে অরণ্যভূমি নষ্টই হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ। অরণ্য বাঁচানোর জন্য যৌথ বন পরিচালনা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তাতে অরণ্য থেকে দ্রুত লাভের আশায় বদলে ফেলা হচ্ছে অরণ্য প্রকৃতি। সামাজিক বনসৃজনের নামে লাগানো হচ্ছে ইউক্যালিপ্টাস জাতীয় গাছ। যা এখানকার গাছ নয়। এর ফলে অবলুপ্ত হচ্ছে স্বাভাবিক বনভূমি এবং তার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা তৃণভোজী প্রাণির দল। স্বাভাবিক ভাবেই খাদ্যের অভাবে জঙ্গল ছাড়ছে মারা যাচ্ছে মাংসাশী বন্যপ্রাণিরা। ঘন জঙ্গল ফাঁকা হয়ে পড়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় স্থানান্তরিত হচ্ছে সরীসৃপ ও উভচর প্রাণিরা।
সরকারের সদর্থক পদক্ষেপের অভাবে এই অঞ্চলের বনভূমিকে সংরক্ষিত বনভূমির আওতায় আনা হয়নি, যেটা করার ফলে রক্ষা পেয়েছে উত্তরবঙ্গের অরণ্যগুলি। বনভূমির পরিবর্তন এক দিকে যেমন একাধিক প্রাণির অবলুপ্তির কারণ, অন্য দিকে, আর্বিভাব ঘটছে এমন প্রাণির যা এই অঞ্চলের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়।
সচেতনতা প্রসারের ফলে আদিবাসী শিকার উৎসবের প্রকোপ অনেকটাই কমেছে। যদিও মানি, তা একেবারেই বন্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু অন্য দিকে, আজও তো নির্বিচারে চলে বৃক্ষচ্ছেদন এবং অরণ্য হনন। অন্য ভাবে। সে কাজ কেন কারও নজরে পড়ে না!
লেখক বাঁকুড়ার সাহিত্যকর্মী