গত বৃহস্পতিবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী। ফাইল চিত্র।
প্রধানমন্ত্রী মোদী তবে আর একটি রেকর্ড তৈরি করিলেন। এই প্রথম সংসদকক্ষে কোনও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য হইতে একটি গোটা বাক্য ‘অসংসদীয়’ অভিযোগে সংসদের কার্যবিবরণী হইতে বাদ দেওয়া হইল। রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে বিরোধী প্রার্থী বি কে হরিপ্রসাদ পরাজিত হইবার পর তাঁহার উদ্দেশে নিম্নরুচির আক্রমণ করিয়া প্রধানমন্ত্রী এই বিরাট ‘কৃতিত্ব’-এর অধিকারী হইলেন। বিরোধী সাংসদরা একযোগে সরব হইয়া উঠিতে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বেঙ্কাইয়া নায়ডুর পক্ষে আর পিছু হটা সম্ভব হয় নাই। বিতর্ক আর বাড়িতে না দিয়া তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত লইলেন। ভারতীয় নাগরিকবর্গ নায়ডুর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। দেশের শীর্ষ নেতার এমন বিবেচনাহীন কথাবার্তা যে ত্বরিত দেশের সংসদের কার্যবিধিতে অস্বীকৃত হইল, তাহা অতীব স্বস্তিজনক। কাহাকে শিষ্টাচারের সীমারেখা বলে, সংসদে দাঁড়াইয়াও দেশের প্রধানমন্ত্রী তাহা মনে না রাখিতে পারেন, কিন্তু তাহা বলিয়া দেশের অন্যরা যে এখনও শিষ্টতার একটি মানদণ্ড মানিয়া চলেন, সেই সংবাদ তো দেশে স্বস্তির বাতাস বহাইয়া দিবেই।
অথচ এই নরেন্দ্র মোদীই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথম বার সংসদে পা রাখিয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়াছিলেন। সামনাসামনি কিংবা দূরবর্তী দেশব্যাপী দর্শক তাঁহার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের দিকে তাকাইয়া আছে এই কথা মাথায় রাখিয়াই তিনি বার্তা দিতে চাহিয়াছিলেন যে, দেশের গণতন্ত্রের শীর্ষ মন্দিরটিতে প্রধান নেতা হিসাবে আসিতে পারিয়া তিনি ধন্য। তাঁহার সেই ‘ধন্য’ ভাবটি অবশ্য বেশি দূর স্থায়ী হয় নাই। ক্ষমতার মোহিনীমায়ায় আচ্ছন্ন হইয়া তিনি দ্রুত গণতন্ত্রের গোড়ায় আঘাত করিতে শুরু করিলেন, পরিচয়-নিরপেক্ষ ভাবে দেশের সমস্ত নাগরিকের যে মর্যাদা প্রাপ্য, জনসাধারণের এক বিরাট অংশকে তাহা দিতে অস্বীকার করিলেন। এবং সেই ক্ষমতান্ধতার ক্রম-পরিণাম হিসাবেই আসিল রাজ্যসভার অন্যতম নেতৃপদের প্রার্থীকেও সর্বসমক্ষে এমন অসম্মান। একটি সংশয় অনিবার্য— প্রথম দিনের সেই বিখ্যাত আজানু নমস্কারে এবং বৃহস্পতিবার বি কে হরিপ্রসাদ সম্পর্কে অসম্মানজনক উক্তিতে কি একই মনোভাবের আভাস: সস্তায় করতালি পাইবার প্রবল অভীপ্সা? প্রধানমন্ত্রী যদি নিজের সাংবিধানিক মর্যাদার কথা ভুলিয়া করতালির জনপ্রিয়তাকেই বেশি গুরুত্ব দেন, তাহা হইলে রাষ্ট্রের যে দুর্ভোগ হয়, এখন তাহাই ঘটিতেছে। আর সেই কারণেই নিজের ব্যবহারের উপর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিয়ন্ত্রণ থাকিতেছে না। ক্ষমতা নামক মাদকটি এমনই— শেষ পর্যন্ত মাথায় উঠিয়া সর্বনাশ ঘটাইয়া তবে ছাড়ে।
মোদী-সমর্থকরা বলিবেন, সামান্য বিষয়ে এত বাড়াবাড়ির কী আছে। একটিই তো অমর্যাদাময় বাক্য, মুখ ফস্কাইয়া উচ্চারিত, তাহার বেশি কিছু তো নহে! উত্তরে বলিবার, বিষয়টি মোটেই সামান্য থাকে না যদি বোঝা যায় প্রতিটি মুখনিঃসৃত বাক্যের পিছনে আসলে একটি মস্তিষ্কপ্রসূত মনোভাব থাকে। বিরোধী ব্যক্তিকে যিনি মানুষ বলিয়া মনে করেন না, প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাকে যিনি পদে পদে ব্যক্তিগত আক্রমণে ছোট করিবার চেষ্টা করেন, বিরুদ্ধ দলের প্রতি রাজনৈতিক আক্রমণ বলিতে পরিবার-বংশ ইত্যাদি কেন্দ্র করিয়া ব্যঙ্গবিদ্রুপ হানাই বোঝেন, তাঁহার মনোভাব যে এমন ধরনের হীন বাক্য মুখে আনিয়া ফেলিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী। নেহরু পরিবার লইয়া কুবাক্যবর্ষণ যাঁহার প্রত্যহ-কৃত্য, তিনি সম্ভবত জানেন না যে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু সংসদীয় আচারব্যবহারকে কোন উচ্চ মানে লইয়া গিয়াছিলেন, চরম প্রতিবাদী বিরোধীকেও কেমন সম্পূর্ণ সম্মানের সহিত সম্ভাষণ করিতেন। নেতৃত্ব বস্তুটি ভোটের বাক্স হইতে উত্থিত হয় না, তাহা অর্জন করিতে হয়। দুর্ভাগ্য নরেন্দ্র মোদীর, তিনি ভারতবাসীর নেতা হইতে পারেন নাই।