ফুসফুস ভরিবার বায়ু, ফসল ফলাইবার জল নিশ্চয় নগণ্য বস্তু। নচেৎ, কেন্দ্রীয় সরকার এই বস্তুগুলিকে রক্ষা করিবার অঙ্গীকার হইতেই সর্বাগ্রে পিছু হটিল কেন? কৃষি আন্দোলনের ধাক্কায় বিব্রত নরেন্দ্র মোদী সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপস করিবে, তাহা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু প্রথম দফাতেই আন্দোলনরত কৃষকদের যে দুইটি দাবি মানিতে সম্মত হইল কেন্দ্র, তাহা বিস্ময়কর। প্রথমত, রাজধানী দিল্লি ও তাহার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করিতে যে অধ্যাদেশ (২০২০) আনিয়াছিল কেন্দ্র, তাহার আওতা হইতে কৃষকদের বাদ রাখিল। ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়াইয়া পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করিবার কঠোর শাস্তি ধার্য করিয়াছিল ওই আইন। এখন পঞ্জাব-হরিয়ানার চাষির দাবি মানিয়া কেন্দ্র জানাইল, ওই আইনের আওতা হইতে বাদ পড়িবেন ফসলের অবশিষ্টাংশ দগ্ধকারী কৃষকেরা। তাজ্জব বটে। কৃষক ব্যতীত কে-ই বা খেতের খড় পুড়াইবে, কেনই বা? সন্দেহ জাগে, অতঃপর সরকারকে চাপে ফেলিতে পারিলে হয়তো ট্র্যাফিক আইনের আওতা হইতে গাড়িচালকদেরও অব্যাহতি মিলিতে পারে। আক্ষেপ, যে সরকার নিয়ম বানাইয়াছিল, রাজনৈতিক কৌশলের প্যাঁচে সেই সরকারই অধ্যাদেশকে ‘শোলার মুগুর’ বানাইল। বায়ুদূষণ কমাইয়া জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা করিবার দায়বদ্ধতাও কার্যত অস্বীকার করিল সরকার। দ্বিতীয়ত, প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ সংশোধন আইন (২০২০) প্রত্যাহার করিতে রাজি হইল কেন্দ্র। এই প্রস্তাব লইয়া বিতর্ক উঠিয়াছে। বিদ্যুৎ যৌথ তালিকার বিষয়, রাজ্যের স্বাধিকারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করিয়াছে রাজ্যগুলি। তৎসহ কৃষকরাও বিদ্যুৎ সংশোধন বিল প্রত্যাহারের দাবি করিয়াছেন।
ভারতের প্রায় সকল রাজ্যই ভর্তুকি দিয়া কৃষককে সুলভে বিদ্যুৎ দিয়া থাকে। পঞ্জাব-হরিয়ানার চাষি বহু বৎসর বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পাইতে অভ্যস্ত। এ বৎসর আইন সংশোধন করিয়া, বিদ্যুতের দামে ভর্তুকি বাতিল ও ভর্তুকির অর্থ সরাসরি চাষির অ্যাকাউন্টে পাঠাইবার প্রস্তাব করিয়াছে কেন্দ্র। কারণ, সরকারি ভর্তুকির ভরসায় অধিকাংশ রাজ্যের বিদ্যুৎ পর্ষদ অত্যন্ত অদক্ষ, ঢিলেঢালা ভাবে চলিতেছে। ক্ষতির পরিমাণ মাত্রা ছাড়াইয়াছে, কিন্তু রাজ্যগুলির জনমোহিনী নীতি এবং রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দুর্নীতির পরিবর্তন নাই। তৎসহ, সুলভে বিদ্যুৎ মিলিবার জন্য সেচে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার ক্রমে বাড়িয়াছে। ভারতের বহু রাজ্যে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর দ্রুত নামিতেছে। পঞ্জাব-হরিয়ানাতে জলস্তরের ক্ষয় এমনই ভয়ানক যে, তাহা উপগ্রহ-চিত্রেও প্রতীয়মান। ইহার প্রতিকার: ধানের চাষ কমাইয়া স্বল্প জলের উপযোগী ফসলের চাষ। কিন্তু পঞ্জাব-হরিয়ানার আন্দোলনরত কৃষকরা যে দাবিগুলি করিতেছেন— ধান-গমের সরকারি ক্রয়ের নিশ্চয়তা, এবং সুলভে বিদ্যুৎ— তাহাতে বর্তমান ব্যবস্থাকেই দীর্ঘায়িত করিবার আগ্রহ প্রকাশ পাইতেছে।
কৃষিক্ষেত্রে নানা অনিশ্চয়তার জন্য কৃষকরা স্থিতাবস্থা বজায় রাখিতে চাহিবেন, তাহা আশ্চর্য নহে। রান্নার গ্যাসে ভর্তুকির অভিজ্ঞতাও তাঁহাদের সন্দিগ্ধ করিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণ, জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং কৃষির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিশ্চিত করা সরকারের কর্তব্য। কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার করিতে উদ্যোগী হইবার পর সরকার এই তিনটি লক্ষ্যেরই বিপরীতমুখী শর্ত বিনা আলোচনায় স্বীকার করিয়া লইল। তাহা হইলে কৃষিক্ষেত্রে নূতন আইনের প্রয়োজন কী? সংস্কার রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয় নহে। আগামী দিনে ভারতে কৃষি কেমন হইবে, তাহার একটি সুসংহত রূপ সরকারের চিন্তায় থাকিবার কথা। রাজনৈতিক আপসের উদ্দেশ্যে তাহার হানি করিলে সংস্কারের উদ্দেশ্যই নষ্ট হইয়া যায়। পরিবর্তনহীন সংস্কার, এই কি ভারতের নিয়তি?