তেইশ জোড়া হাত শূন্যে তোলা, হাতে হাতে জোড়া। এমন চমৎকার ছবি সহজে মেলে না। সে দিক দিয়ে দেখলে ঐতিহাসিক অবশ্যই। এত রকম বিরোধী নেতানেত্রীকে এক জায়গায় আনা কম কথা নয়! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব একবাক্যে মানতে হবে। তবে তার পরেও বলতে হবে, সবচেয়ে বড় কৃতিত্বটা শ্রীযুক্ত মোদীরই। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, মঞ্চ আলো করা বিবিধ রতনকে একত্র বসানোর জন্য যে আঠাটা কাজ করেছে, তার নাম মোদী-বিরোধিতা। মোদী তাঁর ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ভাল করে চাপড়ে নিতে পারেন— পৌনে পাঁচ বছরে এমন ভেলকি আগে কেউ দেখিয়েছে বলে তো মনে হয় না, যার ঠেলায় আসমুদ্র-গোবলয় এতগুলি দলের নেতারা খেপে উঠে কলকাতার ব্রিগেড অবধি পৌঁছে গিয়েছেন।
ঘরপোড়া ভারতীয়দের মন যদিও আশার সঙ্গে আশঙ্কাতেও দুলছে। এই সমাবেশ জরুরি তা নিয়ে সন্দেহ নেই— নেতাদের জন্যও, আমাদের জন্যও। নেতাদের মনোবল বাড়ানোর জন্য একত্র হতে পারাটা জরুরি ছিল। আর তাঁদের একত্র দেখতে পাওয়াটা আমাদের মতো ত্রস্ত বিপর্যস্ত নাগরিকদের জন্য জরুরি ছিল। কিন্তু পাশাপাশি এটাও বলতেই হবে যে, এই সমাবেশ শুধুমাত্র প্রথম ধাপ, এর পরের ধাপগুলো যেন ‘মিস’ না হয়! কিসের ওপর ভর করে আছে এই মহাজোট, কী ভেবে হাতগুলো পরস্পরকে ধরেছে, সে সব যেন নাগরিকরা বুঝতে পারেন এবং তাঁদের যেন বোঝানোর চেষ্টা করেন নেতানেত্রীরা। স্বীকার করতেই হবে, সে দিনের সমাবেশে কিন্তু সেটা ভাল করে বোঝা যায়নি। ঐক্যের ছবিটা দেখা গেলেও ঐক্যের সূত্রগুলো দেখা যায়নি। ‘‘মোদী সরকারের মেয়াদ ফুরিয়েছে’’, বললেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদীর বিরুদ্ধে লড়ে তাঁর মেয়াদ শেষ করতে যে প্রত্যেকেই আগ্রহী, সেটা বোঝা গেল। কিন্তু তার সঙ্গে এঁদের নিজেদের মধ্যেও যে অনেক রকম ‘লড়াই’ আছে, সেগুলো কেমন করে মেটাবেন, তার হদিস মিলল না। যে দেশ অতীতে বহু জোট ভেঙে যেতে দেখেছে, এইটুকুতে সে যদি পুরোপুরি আশ্বস্ত বোধ না করে তাকে খুব দোষ দেওয়া যায় কি?
এ বারের মহাগঠবন্ধনের প্রদর্শনীটির পিছনে উত্তরপ্রদেশে তিনটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বোঝাপড়ার ভূমিকা ছিল গুরুতর। ঠিকমতো সেটা না হলে সমাবেশও এ ভাবে জমত না হয়তো। অর্থাৎ বিজেপির বিরোধিতার পরও একটা কথা থেকেই যাচ্ছে— নিজেদের বিরোধিতাটা ঠিকমতো মিটিয়ে একটা সন্ধির জায়গায় আসা, এবং সেই সন্ধির প্রকৃতি বিষয়ে জনগণকে অবহিত করা। নিজেদের মধ্যে ঐক্যসূত্র আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষকে সেটা জানানো কিন্তু অত্যন্ত জরুরি দায়িত্ব হিসেবে পালন করতে হবে, যাতে জনগণ এমন না মনে করেন যে সবাই কেবলমাত্র ক্ষমতার লোভেই ব্রিগেড পর্যন্ত ছুটে এলেন। প্রসঙ্গত, যোগেন্দ্র যাদব এবং অন্যান্যরা ইতিমধ্যে এমন একটা কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁদের মতে, প্রতিটি পার্টিই প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনের দিকে চোখ রেখে এই জোটে নাম লিখিয়েছেন। এই প্রচারটা খুব বিপজ্জনক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্য নেতানেত্রীদের এটা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সেই কারণে, এই সমাবেশ প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। বাকি কাজটা কিন্তু এখনও বাকি।
অন্য একটা কারণেও ‘বাকি কাজ’ এখনই শুরু করা উচিত। যোগেন্দ্র যাদবদের কথা যদি বাদও দেওয়া হয়, ভারত জুড়ে মিডিয়া-শাসনকারী পরাক্রান্ত শাসক দল কিন্তু ঠিক এই জায়গাটাকে ধরেই পাল্টা প্রচার শুরু করে দিয়েছে। আসলে বিরোধীদের এতটা ঐক্যবদ্ধ ছবি শেষ অবধি দেখা যাবে, বিজেপি তা নিশ্চয় ভাবেনি। ‘কাটান’ হিসেবে তাদের এখন একটা পাল্টা স্ট্র্যাটেজি চাই। তার শুরুটাই হল জোর গলায় বলে চলা— এ বারের লড়াই হল মোদী বনাম ‘কেয়স’ বা ‘খিচুড়ি’ জোটের লড়াই। বিজেপির প্রচারকদের মতে, পাঁচ বছরের বদলে দশ বছর পেলে মোদী সরকার দেশকে ‘উন্নতি ও প্রগতি’র পথে এগিয়ে দেবে, কিন্তু খিচুড়ি জোট ক্ষমতায় এলে তারা কী দেবে? যাদের নিজেদের মধ্যেই ঠিকঠাক বাঁধন নেই, তাদের পক্ষে কী-ই বা দেওয়া সম্ভব? অর্থাৎ সারাৎসার: আগামী ভোটের যুদ্ধ হল নিশ্চিতি বনাম অনিশ্চয়তার যুদ্ধ। আগামী কয়েক মাস বিজেপির এই বক্তব্যই আমরা শুনব।
এইখানটাতেই সাবধান হওয়া চাই। সত্যিই তো, ‘অনিশ্চয়তা’র কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, বাঁধনটা শক্ত কি না, জানাও যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, জোটনেতারা তা বলছেন না। না বলার কারণ হিসেবে জানাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা তো কোনও বড় কথা নয়, বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়ে তার পর সে সব ভাবা যাবে’খন। ঘরপোড়া ভোটাররা কিন্তু মনে মনে অন্য রকম আশঙ্কা করছেন— এবং বিজেপি সেই আশঙ্কার আগুনে ঘি ঢালছে— প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা আসলে এতই বড় কথা যে এখন সেটা ভাবতে বসলে জোট ফেল মেরে যাবে, আর তাই ভাবনাটাকে আপাতত সরিয়ে রাখা হচ্ছে।
ঘটনা হল, সে দিন নেতাদের মুখে যা শোনা গেল সে সবই মূলত বিরুদ্ধ বা ‘নেগেটিভ’ প্রচার। মোদীর শাসন খারাপ, অন্যায়, এখনই তার পরিবর্তন জরুরি। কিন্তু এগুলো তো নাগরিকরা জানেন। তাঁরা জানতে চান, পরিবর্তনের পর এই জোট কী দিতে পারে। তাই একটা সদর্থক কর্মসূচির কথা তাঁদের শোনানো দরকার ছিল। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা ছাড়া তেমন কিছু কিন্তু শোনা গেল না। তার মানে এই নয় যে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপক্ষতা বস্তু দুটো সামান্য ব্যাপার। কিন্তু ঠিক কী ভাবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অন্য সাংবিধানিক সুনীতিগুলিকে ফিরিয়ে আনা হবে, সেটা জানলে শ্রোতা-দর্শকরা বুকে আর একটু বল পেতেন।
এই যেমন, চন্দ্রবাবু নায়ডু জিএসটি-সহ ভ্রান্ত অর্থনৈতিক নীতির কথা তুললেন, কিন্তু বিকল্পের মধ্যে এক পা-ও না গিয়ে পরের বাক্যেই বলে দিলেন ‘‘অপোজ়িশন নিড্স টু হ্যাভ ওনলি ওয়ান গোল: টু ডিফিট দ্য বিজেপি।’’ তাঁদের কারও মনে হল না— যে ‘অপোজ়িশন’-এর মধ্যে এত রকম রাজনীতির কাটাকাটি টানাটানি আছে, অন্তত একটা ‘কমন মিনিমাম অ্যাজেন্ডা’ বা ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি তাদের তৈরি করতে হবে। ‘ভোটের পর সব হবে’ বলে বিষয়টাকে পাশে সরিয়ে রাখলে চলবে না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যে ভোটাররা তাঁদের মূল্যবান ভোটাধিকার ব্যবহার করতে চলেছেন, তাঁদের কি জানার অধিকার নেই, ভোট দিয়ে তাঁরা কী পেতে চলেছেন? কেবল কী না-পেতে চলেছেন, এইটুকু জানাই কি যথেষ্ট? ‘এখন কেবল জিতিয়ে দিন আমাদের, বাকি কথা পরে হবে’— এটা বলার মধ্যে আসলে ভোটারের প্রতি একটা অপমান আছে। আমরা কি এখন তা হলে সেই জায়গাতেই এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে ‘বাকি কথা পরে হবে’ শুনেও আমরা প্রচণ্ড আশ্বস্ত বোধ করি?
নরেন্দ্র মোদীর পৌনে পাঁচ বছরের পর আমরা অনেকেই হয়তো ত্রাহি ত্রাহি রবে বলব, হ্যাঁ ভাই, এই যথেষ্ট, এতেই আমরা খুশি। কিন্তু আশঙ্কা হয়, সেই ‘আমাদের’ সংখ্যাটা খুব বিরাট নয়। অন্তত ‘আমাদের’ কথা ভেবে এগোলেই বিরোধী জোটের চলবে না। যাঁরা এইটুকুতে আশ্বস্ত হচ্ছেন না, যাঁরা এখনও মাঝামাঝি বিচরণ করছেন, বিরোধী জোটকে তাঁদেরও নিজেদের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করতে হবে। তাঁদের সামনে একটা বিকল্প ছবি তুলে ধরা দরকার। ক্রমাগত ‘পরে হবে’ কথাটা কৌশল হিসেবে ভাল নয়!
আসলে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের দলের একটা বড় অ্যাডভান্টেজ হল ‘উইল টু পাওয়ার’ বা ক্ষমতালাভের তাগিদ। যিনি ইতিমধ্যেই শাসকের চেয়ারে, এমন একটা আকাঙ্ক্ষা দিয়ে তাঁরা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। তাঁদের বিরুদ্ধে জোরদার লড়াইয়ে যদি নামতেই হয়, তবে বিরোধীদেরও তেমন ইচ্ছা এবং ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। কিছু পাওয়ার সঙ্গে কিছু ছাড়ার ইচ্ছা ও ক্ষমতারও প্রমাণ চাই। তবেই বোঝা যাবে তাঁরা জোট হিসেবে খিচুড়ি না পোলাও।