ছবি পিটিআই।
অনতিঅতীতে শিষ্টতার একটি সর্বজনমান্য রীতি ছিল— আত্মপ্রশংসা না করা। অভিভাবকরা সন্তানকে শিখাইতেন, যদি ভাল কিছু করিতে পারো, তবে পাঁচ জনেই তাহা বলিবে; নিজে বলিবার প্রয়োজন হইবে না। রকমসকম দেখিয়া অনুমান করা চলে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রাচীনপন্থী শিষ্টতায় বিশ্বাসী নহেন। তাঁহার গুণগান করিবার জন্য মন্ত্রীরা আছেন, ভক্তবৃন্দ আছে, এমনকি গোটা আইটি সেল আছে— তবুও, তিনি নিজেই স্বপ্রশংসায় দশানন। যে কথা তিনি বলিয়াই থাকেন, সম্প্রতি আরও এক বার বলিলেন— তিনি গত সাড়ে ছয় বৎসরে যত কাজ করিয়া ফেলিয়াছেন, দেশ যতখানি আগাইয়া গিয়াছে, তাঁহার শাসনকালের পূর্বের দুই-তিন দশকেও তাহা হয় নাই। তুলনার অভিমুখটি কংগ্রেসের দিকে— প্রসঙ্গত, যে কংগ্রেসের আমলে এক দিকে ভারতে টেলিকম বিপ্লব হইতে আর্থিক উদারীকরণ, অন্য দিকে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা হইতে খাদ্য সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত হইয়াছিল। হয়তো প্রধানমন্ত্রী সংস্কার ইত্যাদিকে আলো-হাওয়ার ন্যায় প্রকৃতির দান, এবং কাজ বা খাদ্যের অধিকারকে সাংবিধানিক হরফের অপব্যয় জ্ঞান করেন।
প্রধানমন্ত্রী নিজের কৃতিত্ব হিসাবে উজ্জ্বলা যোজনার কথা উল্লেখ করিয়াছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষা অবশ্য বলিতেছে, ২০৩০ সালেও প্রতি দশটি ভারতীয় হেঁসেলের মধ্যে চারটিতে ‘সলিড ফুয়েল’, অর্থাৎ কাঠকুটা, কয়লা ইত্যাদি ব্যবহৃত হইবে। সেই হেঁসেলগুলি যে দরিদ্রতম বাড়িগুলিতেই থাকিবে, তাহা অনুমান করা চলে। অন্য দিকে, শেষ পরিসংখ্যান অনুসারেও, উজ্জ্বলা প্রকল্পের অধীনে থাকা পরিবারগুলি বৎসরে গড়ে মাত্র তিনটি রিফিল লইয়াছে— অর্থাৎ, যে পরিবারগুলিতে এলপিজি সংযোগ পৌঁছাইয়াছে, সেগুলিও এখনও অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহার করিয়া চলিয়াছে। কেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হইতেছে। প্রকল্পটিকে, অতএব, নির্বিকল্প সাফল্য বলিয়া দাবি করা মুশকিল। প্রধানমন্ত্রীর অন্য ‘সাফল্য’গুলিও একই রকম প্রশ্নযোগ্য। তিনি দ্রুতগতির ইন্টারনেট পরিষেবার বিস্তারের কথা বলিয়াছেন। সংশ্লিষ্ট মহল জানাইয়াছে, প্রধানমন্ত্রী যে হারে বিস্তারের কথা বলিয়াছেন, তাহার জন্য বর্তমান হারের চার গুণ বেগে অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পাতা প্রয়োজন। অলমিতিবিস্তারেণ।
প্রধানমন্ত্রীর ফিরিস্তি হইতে কিছু ‘সাফল্য’-র কথা, হয়তো অনবধানবশতই, বাদ পড়িয়া গিয়াছে। যেমন, তাঁহার আমলেই আর্থিক বৃদ্ধির হার ঐতিহাসিক তলানিতে পৌঁছাইয়াছে। বহু বৎসর পরে একটি গোটা অর্থবর্ষে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হইবার বন্দোবস্ত পাকা। কোভিড-১৯’এর দোহাই দেওয়া চলিবে না, কারণ ভারতের ন্যায় বেহাল আর কোনও দেশই হয় নাই। দেশে কর্মসংস্থানহীনতার হারও তাঁহার আমলেই অর্ধশতকের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাইয়াছে— এবং, তাহা কোভিড-১৯’এর পূর্বেই। গ্রামীণ ভারতে ভোগব্যয় সরাসরি হ্রাস পাইয়াছে। এবং, তাঁহার আমলেই ভারতের পরিসংখ্যান বিশ্বমঞ্চে সম্মানের আসন হইতে নামিয়া নিতান্ত হাসির খোরাকে পরিণত হইয়াছে। দুই-তিন দশকের অগ্রগতির সহিত নিজের আমলের তুলনা করিবার সময় প্রধানমন্ত্রী এই কথাগুলি স্মরণে রাখিতে পারিতেন। আত্মপ্রশস্তির ইচ্ছা হয়তো খানিক কমিত।