দর্শনীয়: নন্দিকেশ্বরী মন্দিরের তোরণ। ছবি: কল্যাণ আচার্য
এখনও বীরভূমের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যকেন্দ্র সাঁইথিয়ার ব্যবসায়ীরা পয়লা বৈশাখ এবং বিজয়া দশমীতে দেবী নন্দিকেশ্বরীকে পুজো দিয়ে ‘সাইত’ করে খেরোর খাতায় ‘সাইতা’ লেখেন। একদা ‘সাইতা’ এখন সাঁইথিয়া নামে পরিচিত। তার আগে দেবী নন্দিকেশ্বরীর নামেই একদা এ শহরের নাম ছিল নন্দীপুর।
বীরভূমের পাঁচটি সতীপীঠের অন্যতম সাঁইথিয়ার দেবী নন্দিকেশ্বরী। এক বিশাল বটবৃক্ষ বটবৃক্ষ ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে মন্দির অঙ্গনটি। কথিত আছে, এই বটবৃক্ষের নীচেই দেবী নন্দিকেশ্বরীর অবস্থান। ভৈরব এখানে নন্দিকেশ্বর। শোনা যায়, দেবী নিজেই স্বপ্ন দিয়ে তাঁর অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন জনৈক দাতারাম ঘোষকে। দাতারাম ছিলেন দক্ষিণেশ্বরের অধিবাসী। ভাগ্য অন্বেষণে বীরভূমে এসে এক সাহেবের কৃপা লাভ করেছিলেন। পরে দেওয়ান থেকে মহাল কিনে জমিদার হয়েছিলেন। এর পর থেকেই দেবী নন্দিকেশ্বরীর পুজো প্রচার হয়। ‘সাইত’ করে মহাল কিনেছিলেন বলে ‘সাইতা’— আর সেখান থেকেই লোকমুখে সাঁইথিয়া নামে পরিচিতি
এ শহরের।
পাঁচটি সতীপীঠ বীরভূমে। বক্রেশ্বরে দেবী মহিষমর্দিনী, লাভপুরে দেবী ফুল্লরা, বোলপুরের কাছে কঙ্কালীতলা, নলহাটীতে নলাটেশ্বরী এবং সাঁইথিয়ায় দেবী নন্দিকেশ্বরী। কথিত আছে, বক্রেশ্বরে পড়েছিল দেবীর ভ্রূ-মধ্য, লাভপুরে অধঃওষ্ঠ, কঙ্কালীতলায় কাঁকাল, নলহাটীতে নলি, এবং সাঁইথিয়ায় কণ্ঠহাড়।
সতীপীঠগুলি নিয়ে অবশ্য নানা গ্রন্থে নানা মত প্রচলিত আছে। বিভিন্ন সতীপীঠের অবস্থান নিয়েও মতান্তর আছে। বিভিন্ন সতীপীঠে সতীর দেহাংশ নিয়েও মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। নন্দিকেশ্বরী নিয়েও বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন মত। তন্ত্রচূড়ামণিতে নন্দিকেশ্বরীকে মূল পীঠ হিসাবে ধরা হয়েছে। এই গ্রন্থে নন্দিকেশ্বরী পঞ্চাশৎ পীঠ হিসাবে পরিচিত। আবার শিবচরিতে সতীপীঠ বর্ণনা থেকে জানা যায়, ৫১টি মহাপীঠ ও ২৬টি উপপীঠের কথা। এই গ্রন্থে নন্দিকেশ্বরী উপপীঠ হিসাবে চিহ্নিত।
সাঁইথিয়া স্টেশনের কাছেই নন্দিকেশ্বরী মন্দির। মোটামুটি শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে নন্দিকেশ্বরীর অবস্থান। এ রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে সাঁইথিয়া যাতায়াতের সরাসরি বাস বা ট্রেন যোগাযোগ আছে। স্বভাবতই সতীপীঠ নন্দিকেশ্বরী দর্শনে পর্যটকদের আগমন বেড়েছে।
বাণিজ্যকেন্দ্র সাঁইথিয়ার বাণিজ্য একদা ছিল নদী-নির্ভর। তখন ময়ূরাক্ষী নদী দিয়ে নৌকা চলত। সেই নৌকায় আসত নানা বাণিজ্যিক পণ্য। একদা এ শহর ছিল জমিদারশাসিত। দাতারাম ঘোষের উত্তরপুরুষেরাই এ শহরের জমিদার ছিলেন। তার পর গ্রাম পঞ্চায়েত। অবশেষে নোটিফায়েড এরিয়ার বাঁধনমুক্ত হয়ে এখন পুর-শহর। ‘নন্দীপুর’ এখন পুরোপুরি সাঁইথিয়া। কিন্তু দেবী নন্দিকেশ্বরীই এ শহর এবং সংলগ্ন এলাকার আরাধ্যা দেবী। নন্দিকেশ্বরীকে কেন্দ্র করেই সাঁইথিয়া এখন বীরভূমের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। তবে সত্তরের দশকেও বাইরের পর্যটকদের কাছে নন্দিকেশ্বরী তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। বহিরাগত পর্যটকেরা বীরভূমে এসে মূলত শান্তিনিকেতন আর তারাপীঠ দেখেই ফিরে যেতেন।
তখন নন্দিকেশ্বরী বলতে ওই বিশাল বটবৃক্ষ আর মন্দিরে দেবী নন্দিকেশ্বরীর অবস্থান। কিন্তু আশির দশকে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে সতীপীঠ নন্দিকেশ্বরীতলা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন শহরের বেশ কয়েক জন নাগরিক। তাঁরা ব্যবসায়ী। সংস্কারের মাধ্যমে মন্দির এলাকাকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হন সাঁইথিয়া শহরের ব্যবসায়ীরা। সমস্যা ছিল অনেক। কিন্তু ব্যবসায়ী তথা নাগরিক সমাজের সমবেত উদ্যোগে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে নন্দিকেশ্বরী মন্দির এলাকার। এখন প্রায় প্রতিদিনই দূর-দূরান্তের পর্যটকেরা দেবী নন্দিকেশ্বরী দর্শনে আসেন।
এই আটের দশকেই মন্দির প্রাঙ্গণে শুরু হয় রথযাত্রা উৎসব। পুরী থেকে জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামের দারুমূর্তি আনা হয়। সেই মূর্তি অভিষেক পর্বের মাধ্যমে নন্দিকেশ্বরী মন্দিরের প্রবেশপথের পাশেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৈরি করা হয় বিশালাকৃতি রথ এবং জগন্নাথদেবের মন্দিরও। সব মিলিয়ে নন্দিকেশ্বরী মন্দির এলাকার চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়। মন্দিরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয় পুরাণনির্ভর নানা চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে। নির্মিত হয় ভৈরব নন্দিকেশ্বরের মন্দির। নন্দিকেশ্বরীতলায় আছে নানা দেবদেবীর মন্দির। মহাসরস্বতী, মহালক্ষ্মী, বিষ্ণুলক্ষ্মী, জলারামবাবার মন্দির, হনুমান মন্দির, জগন্নাথদেবের মন্দির, কালীয়দমন মন্দির আছে একই অঙ্গনে। এগুলির মধ্যে কালীয়দমন মন্দিরটি প্রাচীন।
উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে প্রচুর অর্থ। তখন মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজ আসতেন সাঁইথিয়ায়। তাঁর অলঙ্কার, মুকুট, পাদুকা প্রকাশ্যে নিলাম করে যাত্রীনিবাসের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়। মোহনানন্দ নিজেও উপস্থিত ছিলেন নিলাম সভায়। শুরু হল যাত্রীনিবাস তৈরির কাজ। ‘মোহন মন্দির’ নামে একটি যাত্রীনিবাসের পাশাপাশি একটি সাধারণ যাত্রীনিবাস গড়ে ওঠে শহরের নাগরিক ও ভক্তদের অকৃপণ দানে। এখন সেই যাত্রীনিবাস দু’টিতে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা আছে। দূরের পর্যটকেরা যেমন এখানে এসে থাকতে পারেন, তেমনই নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেও নাগরিকেরা এই যাত্রীনিবাস ব্যবহার করতে পারে।
১৯৮৭ সালে গড়ে উঠেছে নন্দিকেশ্বরী সেবা সমিতি। অতি সম্প্রতি রাজ্যের পর্যটন দফতরের উদ্যোগে মন্দিরের প্রবেশপথে তৈরি হয়েছে সুদৃশ্য তোরণ ও ভক্তদের বিশ্রামস্থল। সারা বছরই নন্দিকেশ্বরী মন্দির এলাকায় ভক্তদের যাতায়াত। নববর্ষ, বিজয়া দশমী, বিভিন্ন ব্রত পার্বণে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। রথ উৎসবে জমজমাট মেলা বসে।
এখন সাঁইথিয়া শহরে বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। ব্যবসায়ীরা আজও দেবী নন্দিকেশ্বরীর পুজো দিয়ে ‘সাইত’ করে ব্যবসা শুরু করেন। তিনটি পুরোহিত পরিবার সারা বছর পর্যায়ক্রমে দেবী আরাধনায় নিয়োজিত থাকেন। থাকেন।একদা বিমলেন্দু সরকার, শৈলেন দাস, নির্মল চন্দ্র প্রমুখ নাগরিকের উদ্যোগে শুরু হওয়া মন্দির উন্নয়নের কাজে পরবর্তীতে হাল ধরেছিলেন নীহার দত্ত, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়, নিমাই দত্ত প্রমুখ। অনেকেই বলেন, নাগরিকদের উদ্যোগে হওয়া নন্দিকেশ্বরী মন্দিরের এই সংস্কার ও উন্নয়ন সাঁইথিয়া শহরের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। পর্যটকদের, এখানে থাকার কক্ষগুলি আরও আধুনিক ও আরামদায়ক হলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে।
লেখক নাট্যকর্মী, প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক (মতামত ব্যক্তিগত)