হোয়াইট হাউসের সামনে প্যালেস্টাইনের পতাকা। ছবি রয়টার্স।
কলকাতায় থাকার সময় সন্ত্রাসবাদ-টাদ তিনি ঢের দেখেছেন, সবাইকে পিটিয়ে সিধে করে দিয়েছেন। তাঁর পরিকল্পনাতেই সেখানকার পুলিশে প্রথম স্পেশাল ব্রাঞ্চ। কিন্তু এখানে, প্যালেস্টাইনের এই ঊষর মরুভূমিতে তিনি, স্যর চার্লস টেগার্ট কী করবেন?
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক। প্যালেস্টাইন ব্রিটিশ অধিকারে। জেরুসালেম থেকে জ়াফা, রামাল্লা নানা জায়গায় প্যালেস্টাইনিরা ইহুদিদের খুন করছে, ইহুদিরাও সমান বদলা নিচ্ছে। ১৯৩৫ সালে সিরিয়া থেকে আসা শেখ ইজ্জত আল দিন আল কসম তাঁর তেরো জন অনুগামীকে নিয়ে ইহুদি ও ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে প্রায় জেহাদ ঘোষণা করলেন। চারশো পুলিশের এক বাহিনী কসমকে ঘিরে ফেলে খতম করে। আজও হামাসের সশস্ত্র ব্রিগেডের নাম কসম ব্রিগেড, ক্ষেপণাস্ত্রেরও নাম কসম রকেট।
ব্রিটিশ পুলিশ দুই পক্ষের গোলমাল থামাতে পারছে না। ইহুদি সামরিক সংগঠন ইরগুনকে সঙ্গে নেয় তারা। ইরগুন আরব জনবসতিতে বোমা ফেলতে শুরু করল। শান্তি ফেরাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আর্ল পিল প্রস্তাব আনলেন, প্যালেস্টাইনে দু’টি রাষ্ট্র তৈরি হোক। সেখানকার ৭০ শতাংশ জায়গা নিয়ে আরব রাষ্ট্র, ইহুদি এলাকার আরব বাসিন্দাদেরও সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু জেরুসালেমের মুফতি মুসা সেই প্রস্তাব মানলেন না, ক্ষমতা বজায় রাখতে তিনি উল্টে হিটলারকে সমর্থন করলেন, অন্য ইসলামি নেতাদেরও গুপ্তহত্যা করালেন। কসমের অনুগামী দলটিও নিজেদের স্বার্থে সেই সব গুপ্তহত্যায় মুফতিকে সাহায্য করল।
গত কয়েক মাস ধরে গাজ়া ভূখণ্ডে ইজ়রায়েল বনাম হামাসের যে যুদ্ধ, তাতে প্যালেস্টাইনকে বোঝা যাবে না। আন্তর্জাতিক নীতি না মেনে হাসপাতাল, স্কুলে ইজ়রায়েলের বোমাবর্ষণ নিয়েও দুঃখ করে লাভ নেই। বরং মনে রাখতে হবে, সেই ট্র্যাডিশনই চলছে! যে ট্র্যাডিশনের শুরুতে, শান্তি ফেরাতে ব্রিটেন থেকে জেরুসালেমে পুলিশ কমিশনার করে পাঠানো হয়েছিল সেই ভারতখ্যাত টেগার্টকে।
টেগার্ট প্রথমে প্যালেস্টাইনের উত্তর সীমান্ত বন্ধ করতে বললেন, যাতে লেবানন, সিরিয়ার দিক থেকে আরবরা কোনও সাহায্য না পায়। দেশ জুড়ে খোলা হল ‘আরব ইনভেস্টিগেশন সেন্টার’। সেখানে, সন্দেহজনক আরবদের নাকে তোড়ে জল ঢুকিয়ে দেওয়া হত কফি পটের নল থেকে। রিইনফোর্সড কংক্রিটে, জলের পাইপ দিয়ে দুর্গের মতো সাজানো হল ৬২টি থানা। আজও সেগুলির নাম টেগার্ট ফোর্ট। প্যালেস্টাইন শেখায়, সে কোনও দুর্বৃত্ত এলাকা নয়। সারা দুনিয়ার ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা।
ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের আরও যে কত উদাহরণ! ম্যাকমাহন লাইন স্মরণ করুন। আজও তাঁর শিমলা চুক্তিতে তৈরি হওয়া সীমান্তরেখাটিকে চিন স্বীকার করে না। এই ম্যাকমাহনকে প্রথম মহাযুদ্ধের শুরুতে মিশরের সুলতানের হাই কমিশনার পদে পাঠাল ব্রিটেন। ম্যাকমাহন মক্কার শাসক হুসেনকে গোপন চিঠিতে জানালেন, আরব বেদুইনরা যেন জার্মান সমর্থক, তুরস্কের অটোমান সুলতানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইংরেজদের সাহায্য করে। তা হলে ভবিষ্যতে সিরিয়া, আরব, ইরাকের উপনিবেশ তিনি হুসেনকে ছেড়ে দেবেন। প্যালেস্টাইন-জেরুসালেমের কথাটি স্বেচ্ছায় উল্লেখ করেননি বুদ্ধিমান ম্যাকমাহন। তিনি জানেন, ওই দেশে ব্রিটিশ ও ফরাসি দুই দেশই দখলদারি করতে চায়! কিন্তু রাশিয়ায় সদ্য ক্ষমতায় আসা বলশেভিকরা এই সব গোপন চিঠি ফাঁস করে দেয়।
বলশেভিক অনেক পরের কথা। জ়ারের আমল থেকেই রুশ ইহুদিরা বারংবার নিগৃহীত। ১৯০৫ সালে ব্যর্থ বিদ্রোহের পর জ়ার দ্বিতীয় নিকোলাস বলেছিলেন, “ইহুদিরা যে খুনে জাত, পরিষ্কার। ওদের নেতা ট্রটস্কি আসলে ইহুদি রাজ্য বানাতে চায়।” দুনিয়া জুড়ে প্রোলেতারিয়েত বিপ্লবের কথা জ়ার স্বপ্নেও ভাবেননি। কিন্তু ১৯১৭ সালে পর পর দুটো ঘটনা ঘটল। আমেরিকা ব্রিটেনের সমর্থনে প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দিল, ‘গণতন্ত্রের সেই পীঠস্থান’-এ অনেকেই রুশদের হাত থেকে ইহুদিদের বাঁচাতে নতুন দেশ চান। রথসচাইল্ড, মন্টেফিয়োর প্রমুখ ধনকুবের ব্রিটিশ ব্যাঙ্কাররাও জাত ইহুদি, তাঁরাও নতুন দেশের সমর্থক। জাতের নামে বজ্জাতিরই তখন রমরমা। ইহুদিকে বিশেষ ধর্মাবলম্বী নয়, ‘রেস’ বা জাতি হিসাবেই গণ্য করা হয়।
দ্বিতীয় ঘটনা, লেনিনের বিপ্লব। ৯ নভেম্বর ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী আর্থার বালফোর জানালেন তাঁর নতুন প্রস্তাব, সরকার প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের নতুন দেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিহাসবিদ সাইমন সিব্যাগ মন্টেফিয়োর কাগজপত্র ঘেঁটে জেরুসালেম, দ্য বায়োগ্রাফি বইয়ে আক্ষেপ করেছেন, লেনিন যদি মাত্র দিন কয়েক আগেও ক্ষমতা দখল করতেন, বালফোর প্রস্তাবের দরকার পড়ত না।
জাতবিচার ছিল, আর ছিল মানচিত্র, প্রত্নতত্ত্বে ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের প্রতিষ্ঠা। ১৮৬৫ সালে লন্ডনে ‘প্যালেস্টাইন এক্সপ্লোরেশন ফান্ড’ তৈরি করা হয়। তার পরই প্রত্নতত্ত্বের সাম্রাজ্য। এই তো এখানেই ছিল রাজা হেরোডের প্রাসাদ, এখানেই ছিল রোমানদের হাতে ধ্বংস হওয়া মন্দির। ইহুদি ইতিহাসবিদের বক্তব্য, অর্ধেক চিহ্নই একেবারে অর্থহীন। জিশুর ক্রুশকাঠ কাঁধে বধ্যভূমিতে হেঁটে যাওয়ার রাস্তা বলে যেটা দেখানো হয়, সেটা অন্য জায়গা। তাঁর আক্ষেপ, ধর্মীয় উন্মাদনার কাছে প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাস পরাস্ত।
এখানেই প্যালেস্টাইনের গুরুত্ব। সভ্যতার সংঘর্ষ নয়— বরং সে জানায়, তার কাছ থেকে আমরা কিছুই শিখিনি।