ধ্রুব রাঠী। —ফাইল চিত্র।
লোকসভা ভোট শেষ হতে বাকি আর এক দফা। দিল্লির কুর্সিতে পরিবর্তন, না প্রত্যাবর্তন— জানা যাবে ক’দিনের মধ্যেই। কিন্তু ফল যা-ই হোক, ধ্রুব রাঠী নামক অনূর্ধ্ব-ত্রিশ যুবক ইতিমধ্যেই এই নির্বাচনের অন্যতম নায়ক। হেলিকপ্টারে উড়ে সভার পর সভা করেননি তিনি; হুডখোলা জিপে রোড-শোও তাঁকে করতে হয়নি। কারণ, তিনি তো প্রার্থী নন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন তিনি। কোনও দলের সদস্য না হয়েও প্রভাবে শাসক-বিরোধী— যে কোনও দলের যে কোনও নামজাদা প্রার্থীর সঙ্গে তিনি পাল্লা দিতে পারেন পরিচিতিতে।
হরিয়ানার ধ্রুব এখন থাকেন জার্মানিতে। পড়তে গিয়েছিলেন সেখানে, এখন চাকরি করেন। সেই সঙ্গেই ইউটিউবে ভিডিয়ো বানান তিনি। এই ‘ইউটিউবার’ ধ্রুব রাঠীই আলোড়ন তুলেছেন এ বারের লোকসভা ভোটে। সেই আলোড়নের শুরু মাস তিনেক আগে তাঁর একটি ভিডিয়ো দিয়েই। সেটির বিষয়, “ভারত কি একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে?” আধঘণ্টার ভিডিয়োতে চণ্ডীগড় মেয়র নির্বাচন, কৃষক আন্দোলনের মতো নানা বিষয়ের প্রসঙ্গ তুলে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার প্রশ্ন তোলেন ধ্রুব। ভোট শেষ হওয়ার মুখে সেই ভিডিয়োর ভিউ ছাড়িয়েছে আড়াই কোটি।
ওই ভিডিয়ো আসলে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। মূল ভিডিয়ো থেকে নেওয়া নানা টুকরো অংশ ছড়িয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের মতো মাধ্যমে। কেবল সমাজমাধ্যমই শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার ধারে, মাঠে পর্দা টাঙিয়ে ধ্রুব রাঠীর ভিডিয়ো দেখানোরও ব্যবস্থা করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। তাঁকে নিয়ে বিজেপি কতখানি চিন্তিত, বোঝা যায় যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজেজু-কে নামতে হয় তাঁর মোকাবিলা করতে।
শুধু বিজেপি-বিরোধিতা নয়। খোদ মোদী সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত ধ্রুবর পুরনো একটি ভিডিয়ো শেয়ার করেছেন, যেখানে ধ্রুব কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সমালোচনা করছেন। ধ্রুব পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন, “সেই সময় আমার করা ওই প্রশ্নগুলো যেমন সত্যি ছিল, এখনকার করা প্রশ্নগুলোও ঠিক সে রকমই সত্যি।” যে দলই ক্ষমতায় আসুক, প্রশ্ন করা চালিয়ে যাবেন তিনি, জানিয়েছেন ধ্রুব। এবং, এখনই যোগ দিচ্ছেন না প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে।
ধ্রুবর ভিডিয়োর এমন প্রভাবের অন্যতম কারণ হল, তাঁর বার্তা একেবারে সরাসরি, সহজ, সপাট। তা ছাড়া ধ্রুব যে-হেতু হিন্দিতে ভিডিয়ো করেন, তাই দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের কাছে সেগুলো বোধগম্য হয়। ইলেক্টোরাল বন্ড, লাদাখের আন্দোলন, হোয়াটসঅ্যাপে আইটি সেলের মগজ ধোলাইয়ের নকশা, বিরোধীদের জেলবন্দি করার মতো বিষয়কে একেবারে সহজ সরল ভাষায় উপস্থাপিত করছেন ধ্রুব। নিজের ভিডিয়ো আরও ছড়িয়ে দিতে পাঁচটি আঞ্চলিক ভাষা— তামিল, তেলুগু, বাংলা, মরাঠি ও কন্নড়ে চ্যানেল খুলেছেন এই এপ্রিলেই।
সমাজমাধ্যমে যাঁরা এমন প্রভাবশালী তাঁদের পরিভাষার সংজ্ঞা ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ নয়, ধ্রুব নিজেকে মনে করেন ইউটিউব-শিক্ষক। আর এ বারের ভোটে ধ্রুবর নানা বক্তব্যকে বিরোধী শিবির ব্যবহার করলেও ধ্রুব স্পষ্ট জানিয়েছেন, কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য নেই। তিনি চান সত্যি কথা বলতে এবং যুক্তি, স্বাধীনতা, প্রগতি ও সবাইকে নিয়ে চলাকে গুরুত্ব দিতে।
কাজ করতে গিয়ে সরকারের রোষের মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। ২০১৮-তে বিজেপির আইটি সেল নিয়ে একটি ভিডিয়োর জেরে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ হয়। তার পরেও ধ্রুব দমে যাননি। বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের জনপ্রিয়তা। এমন জনপ্রিয়তার একটা প্রধান কারণ হল মূলস্রোতের সমাজমাধ্যমের একটা বড় অংশের উপর থেকে আমজনতার আস্থা চলে যাওয়া। দেশের সমাজমাধ্যমের একটা বিরাট অংশকে এখন ক্ষমতাসীনদের কড়া প্রশ্ন করতে দেখাই যায় না। সে কারণেই ধ্রুব যখনই সেই সাধারণ প্রশ্নগুলো সোজাসুজি করেন, তখনই তা আমজনতার অনেকের মনের কথা বলে দেয়। ধ্রুবর বয়ানের সঙ্গে একাত্মবোধ করেন তাঁরা।
জিয়ো আসার পর ভারতে মোবাইল ইন্টারনেটের খরচও কমে। ২০১৫-য় দেশের জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করত, ২০২৩-এ তা দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। আমজনতার মধ্যে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের এমন ছড়িয়ে পড়াটাই একটা বিকল্প সংবাদমাধ্যম গড়তেও সাহায্য করে, যার পরিসর মূলত ইউটিউব। সমীক্ষা বলছে, ইন্টারনেট ব্যবহার করে যাঁরা খবর দেখেন, তাঁদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ ইউটিউবকেই মাধ্যম হিসাবে বেছে নেন।
কিন্তু ভবিষ্যতে কি এই ইউটিউবে থাকা ‘বিকল্প সংবাদমাধ্যম’-এর উপরেও নজরদারি চলবে? মোদী সরকারের ২০২১-এ আনা তথ্যপ্রযুক্তি বিধিতে তার ইঙ্গিত রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি। এ বারের ভোটের আবহেই ‘বোলতা হিন্দুস্তান’ নামে একটি ইউটিউব-নির্ভর খবরের চ্যানেলকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে রয়েছে ট্রোলিং বা ইন্টারনেটের পরিসরে উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের আক্রমণ। যদিও তা নিয়ে চিন্তিত নন ধ্রুব। তাঁর মতে, এটা তাঁর কাজেরই অঙ্গ। যত জন তাঁকে আক্রমণ করে, তার অনেক বেশি মানুষ তাঁকে শুভেচ্ছা, সমর্থন জানান বলেও দাবি করেন ধ্রুব।
৪ জুন ফল যা-ই হোক, এ বারের ভোটে ধ্রুব রাঠীর ভূমিকা প্রমাণ করে দিয়েছে সশরীরে উপস্থিত না থেকে কেবল শক্তিশালী বক্তব্যের মাধ্যমে ভোটের প্রভাবশালী চরিত্র হয়ে ওঠা যায়। তাই তিনিই এই ভোটের ধ্রুব-তারা।