আমরা জানি গত কয়েক বছরে একরোখা হিন্দুত্বের ধারণাকে ক্রমে প্রশ্ন করতে থাকা বুদ্ধিজীবীরা কী ভাবে রক্ষণশীল শক্তির হাতে পর পর খুন হন। অন্ধ ধর্মশক্তির বিরোধী তিনটি যুক্তিবাদী নাম একত্রে, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে আর এম কালবুর্গি। ২০১৭ সালে তালিকায় যুক্ত হন গৌরী লঙ্কেশ।
তবে এই আলোচনা ক্রমে ধর্ম বনাম যুক্তিবাদের চেনা ধাঁচায় চলে যেতে থাকে। এই চার ব্যক্তিত্ব যে আলাদা আলাদা অবস্থান থেকে তাঁদের হিন্দুত্ববিষয়ক প্রশ্নগুলি তুলছিলেন, আর সেগুলি যে সাদামাটা যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক অবস্থান নয়, সেই জটিলতাটি একেবারে অনুপস্থিত থেকে যায়। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে যুক্তিবাদ মানেই তো পশ্চিমি আলোকপ্রাপ্তির হাতফেরতা অবস্থান নয়, বরং জাতপাত, ধর্মসম্প্রদায় ও গোষ্ঠীচেতনা নিয়ে ভারতীয় ও হিন্দু আত্মপরিচয় বিষয়ক খুবই জটিল একটা প্রতর্ক। তাকে বুঝে উঠতে গেলে আমাদের শুরু করতে হতে পারে মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে।
ইতিহাস বলতে ইতিহাস বই না হলেও চলবে। তা হতেই পারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের লাইব্রেরির কোনায় নবনীতা দেব সেনের লেখা ‘বীরশৈব সন্তকবি এবং বীরশৈব সাধনা’ বইটি। চটি বই। ছাপা হয়েছিল কর্নাটকের মুরুসাবী মঠ থেকে ১৯৮৭ সালে। সঙ্গে পড়া যেত ওই বছরই ছাপা হওয়া বীরশৈব কবিদের একশোটি কবিতার কন্নড় থেকে ওঁর করা বাংলায় অনুবাদ, ‘শতেক বচন’, যা নবনীতাদি শেষ করেছিলেন ১৯৮৩-তেই। ‘বচন’ বীরশৈব/লিঙ্গায়ত শরণ কবিদের ধর্মীয় উপলব্ধির কাব্যিক রূপ। নবনীতাদি অবশ্য বীরশৈব আর লিঙ্গায়তদের মধ্যে পার্থক্য করেননি, যা ছিল কালবুর্গি ও গৌরীর বক্তব্য। লিঙ্গায়ত গোষ্ঠী তাঁদের আচারে-বিচারে-ঈশ্বরচেতনায় বীরশৈবদের থেকে আলাদা, অতএব তাঁদের ব্রাহ্মণ্যবাদী বীরশৈব সমাজের এককোণে ঠাঁই না দিয়ে দেওয়া হোক আলাদা ধর্ম পরিচয়, এই নিয়ে কর্নাটকে লিঙ্গায়তদের যে আন্দোলন কালবুর্গি ও গৌরী ছিলেন সেই আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। ১৯৮৩ নাগাদ অবশ্য এই ভাগাভাগিটা বোঝার সুযোগ ছিল না। দ্বাদশ শতকে গুরু বাসবান্নার নেতৃত্বে শৈব নবজাগরণের সূচনা হয়, তখন থেকে প্রায়ই এই দু’টি শব্দ অভিন্ন ভাবে বচনে ব্যবহার হয়েছে। তাঁরা পুরোহিতের ধার ধারেন না, তাঁদের আচারে অগ্নি আবশ্যিক নন, ধর্মাচরণের অধিকার সর্বজনে। কায়িক শ্রম আধ্যাত্মিক মূল্য সম্পন্ন।
এখন লিঙ্গায়ত সম্প্রদায় নিজেদের ব্রাহ্মণ্যবাদী বীরশৈবদের থেকে আলাদা করে রাখতে চান। অতশত না হলেও কিন্তু ওই বীরশৈব বিষয়ক বইতেই নবনীতাদি স্বভাবসুলভ ঠোনায় বলেন, “কিন্তু যে কোনও ‘বিপথগামী’ সন্তানকেই শেষ অবধি সর্বংসহা হিন্দু সমাজ পরম যত্নে ফিরিয়ে নেয়। তাই আজ বীরশৈবরা লিঙ্গায়ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আবার ফিরে গিয়েছে সেই জাত-বর্ণ-বংশের গণ্ডির মধ্যে।’’ এ ভাবেই তিনি তাঁর অন্য অত্যুজ্জ্বল সহকর্মীদের মতোই শিখিয়েছিলেন তুলনামূলক সাহিত্য হতে পারে ভারতের বহুস্তরবাদী ইতিহাসকে বোঝার পথ। আর তা করতে বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, এমন শিক্ষকদের মতো, নবনীতাদিরও প্রকল্প ছিল অনুবাদ ও অনূদিত ভাষাসাহিত্যের বিশ্লেষণ।
সমালোচকরা বলেছেন বচনগুলির নবনীতাকৃত অনুবাদ সুস্বচ্ছন্দ ইংরেজি অনুবাদের থেকেও গভীর ও কাব্যসুষমামণ্ডিত। সে তো নবনীতাদি নিজে কবি বলেই। নারী লিঙ্গায়ত শরণ যেমন আক্কা মহাদেবী বা মুক্তাইয়াক্কার উচ্চারণে নিহিত সংরাগ ও সমর্পণ, যুক্তির সাহস ও আত্মোদ্ধার, এই সবের মর্ম কি ওঁর নিজের কবিতাকে এসে স্পর্শ করেনি? অনুবাদে অন্যান্য ভাষা সাহিত্য পড়া-ই তুলনামূলক সাহিত্যের মূল শক্তি। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যের কতখানিই বা এক জন অনুবাদক একা অনুবাদ করতে পেরে উঠবেন? সব ভাষা শিখে নেওয়াও তো অসম্ভব। মূল ভাষাটি না জেনে ইংরেজি অনুবাদ থেকে পর্তুগিজ বা ফারসি উপন্যাস অনুবাদ করলেও প্রশ্ন উঠবে, অনুবাদের অনুবাদ দিয়ে সাহিত্য সমালোচনা সম্ভব কি না।
কন্নড় না জানা নবনীতাদি কিন্তু এই কূট সমাধান করে ফেলেছিলেন মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ প্রভুশঙ্করের সঙ্গে জোট বেঁধে। কন্নড় প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ শব্দ পিছু লিখে দেন প্রভু, দিয়ে দেন ইংরেজি গদ্যানুবাদ, নবনীতাদি সেখান থেকে বাংলা করতে থাকেন। ছন্দের ঝঙ্কার, কন্নড় বাক্যের শব্দসজ্জা খেয়াল করেন। কন্নড় উচ্চারণ লিখে দেওয়ার ফলে কোন কোন সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে, তাও স্পষ্ট হয়। অনুবাদই হয়ে ওঠে একটি যৌথ তার্কিক কাজ। এই ঘরানা অনুসরণেই আজ তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে জোট অনুবাদের মাধ্যমে ঘটে চলছে নানা ভারতীয় ভাষাসাহিত্যের মেলবন্ধন। নবনীতাদি তো কবেই কম্প্যারেটিভ লিটারেচার অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার কনফারেন্সের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘‘ওই সব ইংরিজি বনাম দিশি করলে আর চলবে না বাপু, ইংরিজিও কিন্তু এখন ভারতীয় ভাষা। এই জোট অনুবাদের মাঝে একমাত্র নিরুদ্বিগ্ন সর্বভারতীয় যোগসূত্র সে-ই, হিন্দি নয়!’’
নবনীতাদির গবেষণা শুরু অবশ্য মহাকাব্য নিয়ে। তিনি দেখান, সংস্কৃত মহাকাব্য তার বহুমুণ্ডহাতওয়ালা দেবদেবী, যক্ষ-অসুর আর কাহিনির মধ্যে কাহিনির জট পাকানোর জন্য পশ্চিমি এপিক থেকে আলাদা, এমনটা মোটেই না। প্রাচীন ও মধ্যযুগের খান-তেরো এপিকের আলোচনা করে তিনি দেখান যে, প্রাচীন গ্রিক, সংস্কৃত, সুমেরীয় থেকে মধ্যযুগীয় ফরাসি, ক্রোয়েশীয়, ইংরেজি, জার্মান, রাশিয়ান ভাষার এপিকের মধ্যে কী আশ্চর্য সাযুজ্য। ‘ইস্ট ইজ় ইস্ট, ওয়েস্ট ইজ় ওয়েস্ট’ যাঁরা বলেন, তাঁদের মুখে তৎক্ষণাৎ এক গাল মাছি।
সেই থেকেই রামায়ণ নবনীতাদির বিষয়। বিদগ্ধ কন্নড় গবেষক এ কে রামানুজন বলেছিলেন ৩০০ খানা রামায়ণ মিলিয়েই রামায়ণ, মূল পাঠ (উর-টেক্সট) বলে কিছু হয় না। সবাই যে বাল্মীকি রামায়ণকেই ফিরে লিখছেন এমনও নয়, তাই শুধু আছে পুনঃকথন। আজ বুঝতে পারি, নবনীতাদির রামায়ণ প্রকল্প পুরোটাই ছিল রাজনৈতিক।
নবনীতাদি দেখান, গল্পটা রামায়ণের হলেও সেই কাব্য পুনঃকথনের ইতিহাসে ঠাঁই নাও পেতে পারে। আর কোন কোন রামায়ণের কেন ঠাঁই হয় না, সেটা বলতে গিয়ে নবনীতাদি নিয়ে আসেন ষোড়শ শতকের কিশোরগঞ্জের ফুলেশ্বরী পাড়ের ব্রাহ্মণ কন্যা চন্দ্রাবতী আর অন্ধ্রপ্রদেশের নেল্লরের কাছের গ্রাম গোপভরমের কুমোর কন্যা মোল্লাকে (১৯৯৭)। যাঁরা দু’জনেই সংস্কৃতের বদলে নিজ নিজ ভাষায় রচনা করেন রামায়ণ। চন্দ্রাবতী বাংলায়, মোল্লা তেলুগুতে। চন্দ্রাবতী রচিত ‘মলুয়া সুন্দরী’ বা ‘দস্যু কেনারাম’ ময়মনসিংহ গীতিকার অঙ্গ হিসেবে দুই বাংলাতেই বাংলা বিভাগে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে পড়ানোও হয়। কিন্তু তাঁর রামায়ণখানার গুরুত্ব বিচার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে হয়নি। দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন দুর্বল, সুকুমার সেন বলেছেন জাল। কিন্তু নবনীতাদি দেখিয়েছেন আসলে চন্দ্রাবতী রামকে ধরাশায়ী করেছেন কঠোর যুক্তিজালে, নিন্দে করেছেন, সীতাকে দুখিনী করার জন্য তাঁর অভিযোগের আঙুল কখনও রামের দিক থেকে সরেনি, এমনকি অযোধ্যা ধ্বংসের জন্যও দায়ী করেছেন রামকে। পুরো কাহিনিই ঘুরে চলেছে সীতার সঙ্গে সঙ্গে। কোনওক্রমে একটি বাক্যে রাম-রাবণের যুদ্ধ সেরে দিয়ে কথক ফের মেয়েলি বারোমাস্যায় ফিরে যান সীতার বয়ানে। চন্দ্রাবতী তাঁর কাহিনিকে মহৎ মহাকাব্যের সারণিতে পৌঁছতে চাননি। একে মেয়েলি মুখের গীত, তায় সেই গীতিতে রামের ছটাক মাহাত্ম্য নেই, এ কি রামায়ণ হতে পারে, বলুন?
অন্য দিকে শূদ্রের মেয়ে বারাঙ্গনা মোল্লা, তেলুগুতে লিখলেন যখন, মহাকাব্যই লিখতে চাইলেন, অর্থাৎ বাল্মীকির রামায়ণের ফর্মুলাগুলি ধরে রাখলেন। প্রথাভাঙা সীতা নয়, বরং স্থিতধী রাম একদম ছাঁচে ঢালা। ফলে জনপ্রিয়তা খুব। অজস্র সস্তা তেলুগু সংস্করণে মোল্লা মলাটের ওপর ধ্যানমগ্ন। কিন্তু ভুলে না যাই যেন যে, মহাকাব্যের সংজ্ঞা মানলেও শূদ্রকাব্য বলে ও মহিলার রচনা বলে তাঁর কাব্য রাজসভায় পড়ার অনুমতি দেননি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা। মোল্লা বারাঙ্গনা ছিলেন, সমালোচকরা সুবিধেজনক ভাবে তা ভুলে গিয়ে শৃঙ্গাররসের ওপর তাঁর অপার দক্ষতায় তাজ্জব বনে গিয়ে বলবেন, ভাই এক জন কুমারী নারী কী করে কামকলার এত কিছু জানে! আবার কুমারী নারী যে হেতু অক্ষতযোনি হলে সম্মাননীয়, আইবুড়ো চন্দ্রাবতীকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সে কী বিব্রত হয়ে পড়বে।
মেয়েদের গাওয়া রামায়ণের খোঁজে নবনীতাদি নানা দিকে ঘুরেছেন। লিখন ও গায়নকে মিলিয়ে পড়ার পদ্ধতি তৈরি হয়েছে তুলনামূলক সাহিত্যে। বাংলা, মৈথিলি, তেলুগু, মরাঠি ভাষায় মেয়েদের গানে সীতা থাকেন। তাঁদের রাম ‘পাপিষ্ঠ’, সীতার শোকালাপে নিজেদের দুঃখতাপ জানান তাঁরা। নিজেদের জীবনকে দেখতে ও পড়তে পারেন। এই সবই সীতায়ন। সেও নিশ্চয়ই ৩০০র বেশি, না নবনীতাদি?
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়