শান্তিনিকেতনের ‘সই’ নবনীতা...

কাল, সোমবার (১৩ জানুয়ারি) নবনীতা দেব সেনের জন্মদিন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান বোধহয় তৈরি হয়েছিল জন্মের অব্যবহিত পরেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাম রেখেছিলেন নবনীতা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর রক্তে। সেই নবনীতার শান্তিনিকেতনের দিনগুলির স্মৃতিচারণায় কুহেলী চক্রবর্তী যেহেতু শান্তিনিকেতন আশ্রম এবং বিশ্বভারতীর সঙ্গে নবনীতা দেব সেনের আবাল্য ঘনিষ্ঠতা, তাই এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য— ‘আমি সব সময়ে পজিটিভ ভাবনায় বিশ্বাস করতে চাই, তাতে মন ভালো থাকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০৪:১৪
Share:

নবনীতা দেব সেন।— ফাইল চিত্র

বাঙালির রবি-তীর্থে প্রথা ভাঙাই এখন প্রথা। এ বছর পৌষমেলা, খ্রিস্টোৎসব— দু’টি অনুষ্ঠানেই প্রচলিত নিয়মের বেশ কিছু রদবদল দেখা গেল। নতুন বছরে বিশ্বভারতীর বুধবারের সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিও পরিবর্তিত হয়েছে। এ-সব নিয়ে আশ্রমিক এবং ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ বেশ ক্ষুব্ধ। দশটা-পাঁচটার নিগড়ে বাঁধা এই কর্পোরেট সংস্কৃতি তো রবীন্দ্র-ভাবনার সঙ্গে ঠিক মেলে না।

Advertisement

যেহেতু শান্তিনিকেতন আশ্রম এবং বিশ্বভারতীর সঙ্গে নবনীতা দেব সেনের আবাল্য ঘনিষ্ঠতা, তাই এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য— ‘আমি সব সময়ে পজিটিভ ভাবনায় বিশ্বাস করতে চাই, তাতে মন ভালো থাকে। আর যেহেতু জগতে কোনও পরিস্থিতিই চিরন্তন নয়, তাই আমার বিশ্বাস এই ত্রুটিপূর্ণ অবস্থার সংশোধনও একদিন সম্ভব হবে। অন্তত আশ্রমের অঞ্চলটিতে পুরনো মর্যাদায় নতুন করে ফিরে আসবে আমাদের সব হতে আপন শান্তিনিকেতনের সম্ভ্রান্ত পরিবেশ। সবাই মিলে বিশ্বাস করে চেষ্টা করলেই আপাত-অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়’।

তাঁর কথা শুনে আমরা সাহস পাই। আশায় বুক বাঁধি। স্বপ্ন দেখি কবিগুরুর আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার।

Advertisement

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নবনীতার নাড়ির টান বোধহয় তৈরি হয়েছিল জন্মের অব্যবহিত পরেই। রবীন্দ্রনাথ নাম রেখেছিলেন নবনীতা। বয়স তখন মাত্রই তিন মাস। কবি দম্পতি রাধারাণী এবং নরেন্দ্র দেবের কাছে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি আসে, তাতে লেখা— ‘যেহেতু তোমার উপহার প্রত্যাখ্যানের বয়স হয়নি তাই এই নামটি তুমি গ্রহণ কোরো...’। ভারী আশ্চর্যের বিষয় হল, যৌবনে যাঁর সঙ্গে বিবাহসূত্রে ‘ভালবাসা’র কন্যেটি হয়েছিলেন ‘প্রতীচী’র আহ্লাদী বধূ, তাঁর অমর্ত্য নামটিও বিশ্বকবিরই দেওয়া (অমর্ত্য সেনের সঙ্গে যখন সবেমাত্র বাগদান হয়েছে, তখন থেকেই ‘দাদু’ ক্ষিতিমোহন সেন নবনীতাকে ‘আদরের নাতবউ’ সম্বোধনে চিঠি লিখতেন)। এহেন মেয়ের প্রথম শান্তিনিকেতন দর্শন তিন বছর বয়েসে। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে অমিয় দেব সস্ত্রীক, সকন্যা বোলপুরে আসেন। দুপুরে আশ্রমের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সেখানে উপস্থিত। পাতে সাদা ভাত পড়তেই একরত্তি মেয়ে ফুঁসে উঠল... ‘এ কেমন নেমন্তন্ন! পোলাও নেই কেন?’।

উপস্থিত সবাই বিব্রত। দেব দম্পতি লজ্জায় অধোমুখ। মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে এলেন প্রতিমা দেবীর ‘বাবা মশাই’। পুত্রবধূকে চুপিচুপি পরামর্শ দিলেন কমলা লেবুর কোয়া ছাড়িয়ে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। সেই হলদে রঙা ভাত পোলাও ভেবে খেয়ে অবশেষে মেয়ের মন ভরল। এ ভাবেই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ‘দেবকন্যা’র মনবীণার তারটি বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর রক্তে। পেয়েছিলেন ‘মা’ রাধারানী দেবীর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে। ১৯৪১-এর ২২শে শ্রাবণ মধ্যরাতে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে তিন বছরের ‘খুকু’ দেখেছিল, অসম সাহসী ‘মা’কে বাচ্চা মেয়ের মতো আকুল হয়ে কাঁদতে।

১৯৬০ সালে আশ্রম কন্যা অমিতা দেবীর বিশ্বখ্যাত পুত্র অমর্ত্য সেনকে বিয়ে করে নবনীতা এলেন শান্তিনিকেতনে। শশ্রূমাতা নতুন বৌকে নিয়ে গেলেন প্রতিমা দেবীর কাছে। পোলাও-পাগল সেই ছোট্ট মেয়েটিকে লাজুক নববধূর বেশে দেখে তিনি তো বিস্মিত। এ গল্প নবনীতার লেখাতেই পাই। ওঁর সরস পরিবেশনায় ‘প্রতীচী’ বাড়ির প্রত্যেকেই যেন আমাদের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। এমনকি বাড়ির আম, জাম, গোলাপজাম, জামরুল, লিচু গাছগুলিকে নিজের বাড়ির ভেবে ভ্রম হয় মাঝে মাঝে। বন্ধু সারমেয়, কাঠবেড়ালি, বেজি, ইঁদুর, সাপ, পাখপাখালি, মৌমাছি আর দূরন্ত সব হনুমানদের গল্প শুনতে শুনতে আলসে দুপুরে শ্রীপল্লির রাস্তা ধরে, লাল বাঁধের পাড় বরাবর বেমক্কা পৌঁছে যাই খোয়াইয়ের প্রান্তরে। আবার যে-দিন, পথভ্রষ্ট দলছুট দাঁতাল হাতির ‘প্রতীচী’র সদরে হাজির হওয়ার রোমাঞ্চকর গল্প পড়ি, মধ্যরাতের দুঃস্বপ্নে আমাদের ৪৫ পল্লীর কোয়ার্টারে শুনতে পাই হাতির কড়া নাড়া! নবনীতার লেখায় বিশেষ ভাবে জানা যায়, ‘শ্বশুরমশাই’ ডক্টর আশুতোষ সেনের ‘জলের শস্য’ ও ‘মাঠের শস্য’ নিয়ে হাতে কলমে গবেষণার কথা। বীরভূমের চাষিদের নতুন নতুন চাষে উৎসাহ জোগাতেন তিনি। মাছ না ধরে পুকুরে মাছ ছাড়ার ‘মীন মঙ্গল’ ব্রতের কাহিনিও সমান মনোগ্রাহী হয়েছে তাঁর কলমে। এ-সব কাজে তিনি ছিলেন ‘বাবা’র সক্রিয় সহযোগী। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও ছেদ পড়েনি শাশুড়ি, ননদের সঙ্গে বন্ধুতায়, তাঁদের প্রতি কর্তব্যবোধে।

শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রধান দু’টি অনুষ্ঠান বসন্তোৎসব এবং পৌষমেলাতেও ছিল তাঁর নজরকাড়া উপস্থিতি। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে কাটানো বসন্তোৎসবের স্মৃতিচারণায় বলেছেন: ‘একবার দোলপূর্ণিমার আগের রাতে আমরা দু’জনেই শান্তিনিকেতনে, আশ্রমের বৈতালিকে পাশাপাশি হেঁটেছিলুম। ‘সব কুঁড়ি মোর ফুটে ওঠে তোমার হাসির ইশারাতে--!’ গাইতে গাইতে। পৌষমেলায় ছোটবড় নানা সাহিত্য গোষ্ঠীর স্টলে নবনীতা আসতেন, কবিতা পাঠ করতেন। উৎসাহ দিতেন নতুনদের। ‘১৪০০ সাহিত্য আড্ডা’র বর্ষীয়ান কবি, হিন্দমোটরের অরুণ চক্রবর্তী জানিয়েছেন তাঁদের স্টলে নবনীতার কবিতা পাঠের কথা।

‘অচেনাকে ভয় কি আমার...’, শান্তিনিকেতনের আড্ডায় এটি ছিল নবনীতার প্রিয় গান। ‘অমিতা ভবন’-এর স্মৃতি কথায় বলেছেন ওঁর দেওর শান্তভানু সেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মায়ের নামাঙ্কিত এই বাড়িটি থেকেই প্রতীচী ট্রাস্টের সমস্ত কাজকর্ম পরিচালিত হয়। নবনীতা ছিলেন এই ট্রাস্টের উপদেষ্টা। কাজের ফাঁকে প্রায়ই আসতে হতো এখানে। ২০১৭ সালে শেষ বার এসেছিলেন প্রতীচী ট্রাস্টের অনুষ্ঠানে। ‘ভালোবাসা’র আদুরে মেয়ের ভালবাসার টানে কাছের-দূরের, আত্মীয়-অনাত্মীয় মনুষ্যেতর জীবকুল, গাছপালা সবাই একসূত্রে ছিল বাঁধা। তাঁর নিরাপদ কোল ছিল আসন্নপ্রসবা মার্জারমাতার প্রসবকালীন শয্যা। শান্তিনিকেতনের ‘প্রতীচী’তেও তাঁর দূর্নিবার আকর্ষণে প্রভূত লোকসমাগম হত। বৈঠকি আড্ডাও বসত। সে আড্ডায় জমায়েত হতেন কিংবদন্তি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহন সিংহ খাঙ্গুরা থেকে শুরু করে আশ্রমিক শ্যামলী খাস্তগীর, অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রতীন সেনদের মতো কৃতী মানুষজন।

কালের অমোঘ নিয়মে থেমে গিয়েছে সে আড্ডা। রয়েছে কিছু স্মৃতি, কিছু গান। এই আড্ডার আর একটি প্রিয় গান ছিল ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে...’। বাড়ির সমস্ত অনুষ্ঠানে দুই কন্যা-সহ তাঁর সক্রিয় উপস্থিতির কথা শ্রীপল্লির বাসিন্দাদের স্মৃতিচারণে উঠে আসে। পিয়ারসন পল্লীর সুখী সোরেন, কালিপদ হেমব্রমদের মুখে মুখে ফেরে নবনীতার আন্তরিক আতিথেয়তার কথা। ‘প্রতীচী’ বাড়ির সমস্ত অনুষ্ঠানে পিয়ারসন পল্লীর বাসিন্দাদের বিশেষ আমন্ত্রণ থাকত।

‘কাছে থাকো। ভয় করছে। মনে হচ্ছে / এ মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। ছুঁয়ে থাকো।’ এ লেখা নবনীতার। আমরা মেয়েরা, যারা ‘ভালবাসার বারান্দা’য় নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠছিলাম, ইচ্ছেডানা মেলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম নির্ভার ওড়ার, একটু ভয় পেয়েছিলাম বইকি! তাঁকে হারিয়ে আশ্রয়চ্যুত হওয়ার ভয়। ‘সই’-এর আসরে যাইনি কখনও, তবু তিনি আমাদের চিরদিনের ‘সই’! বোলপুর শান্তিনিকেতন স্টেশন থেকে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের সেকেন্ড ক্লাস কামরায় নবনীতাদির মুখোমুখি বসে একদিন পাড়ি দিয়েছিলাম মহানগরীর উদ্দেশে। দেখেছিলাম, একজন সত্যিকারের ‘সেলিব্রিটি’ কত অবলীলায় (যতখানি অবলীলায় নিজেকে ‘ফেলিব্রিটি’ তকমায় ভূষিত করেছেন) ছেঁড়া, নোংরা সিটে শুয়ে দিব্যি ঘুমোতে ঘমোতে পৌঁছে যেতে পারেন গন্তব্যে। ‘জ্বলন্ত পাখনা থেকে আগুন ঝেড়ে ফেলে আবার আকাশ স্পর্শ করতে চাওয়া’র দুঃসাহস তিনিই আমাদের জুগিয়েছেন। এমন মানুষকেই তো অনায়াসে বলা যায় ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ...’।

তাই, হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, নবনীতাকে ছুঁয়ে ছুঁয়েই থাকব সব হতে আপন আমাদের শান্তিনিকেতনে।

তথ্য সূত্র: ‘ভালো-বাসার বারান্দা’, নবনীতা দেবসেন, দে’জ;

কলকাতা দূরদর্শনের স্মৃতিচারণ ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে’;

লেখক বিশ্বভারতীর রসায়ন বিভাগের গবেষক, মতামত নিজস্ব

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement