মজার ব্যাপার, আমরা যখন উৎসবে মাতি, আমরা ধরে নিই চার পাশে সকলেই সেই উৎসবে যোগ দেবেন। অন্য কেউ যে অন্য ভাবে ভাবতে পারেন, এমনটা আমাদের চিন্তাতেও থাকে না। তাই প্রথাগত চিন্তাধারার বাইরে, কলকাতা থেকে কয়েকশো মাইল দূরে আমাদের এই রাজ্যে যখন দুর্গাপুজোকে ঘিরেই এক অন্য আন্দোলনের কথা শুনি, বিস্ময়ের সীমা থাকে না। পুরুলিয়া জেলার এক অখ্যাত গ্রামে আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে, নিজেদের আত্মপরিচয় তুলে ধরতে, নিজেদের মর্যাদাকে মান্যতা দিতে ভূমিপূত্র খেড়ওয়াল আদিবাসীদের প্রতিষ্ঠান দিশম খেড়ওয়াল বীর কালচার কমিটির পরিচালনায় অনুষ্ঠিত হয় ‘হুদুড় দুর্গা (মহিষাসুর) স্মরণ দিবস’। ২০১১ সাল সেটা। সোনাইজুড়ি গ্রামে (কাশীপুর থানার অন্তর্গত) এক তরুণ অজিতপ্রসাদ হেমব্রম এবং তাঁর সহকারী চারিয়ান মাহাতোর উদ্যোগে ঘটে এই পুজো। নিজেদের সংস্কৃতির মৌখিক উপাদানকে সংগ্রহ করেই চারিয়ান মাহাতোর কলম থেকে শহিদ স্মরণ দিবসকে উপলক্ষ করে একটি তীক্ষ্ণ রচনা বেরিয়ে আসে স্থানীয় একটি পত্রিকায়। সে লেখার নাম ছিল ‘হুদুড় দুর্গা’।
কাজটা সহজ ছিল না। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অনেক চাপ, এমনকি মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়েছিল এই দুই তরুণকে। আশ্চর্য নয়, সোনাইজুড়িতে সে দিন যে প্রতিবাদের সূচনা হয়েছিল তা আজ ঢুকে পড়েছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমেও। তার ঢেউ থেকে বাদ যায়নি সংসদও। গত বছর সংসদে ‘মহিষাসুুর’ বিতর্কের কথা আমরা শুনেছি বইকি।
কে এই ‘হুদুড় দুর্গা’? কী জন্যই বা এই হুদুড় দুর্গা স্মরণ দিবসের আয়োজন? কেন হঠাৎ করে এর প্রচার বা প্রসার? এত তাড়াতাড়ি এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লই বা কেন?
আসলে ‘হুদুড়’ কথার অর্থ ‘বজ্রের মতো তেজ বা শক্তি যার।’ আর দুর্গার অর্থ? ‘দুর্গ রক্ষা করেন যিনি’। এই দেশের ভূমিপূত্রদের কাছে হুদুড় দুর্গা আর কেউ নন— তিনি আমাদের সকলের পরিচিত মহিষাসুর। যে অসুরের বিনাশ চান আমাদের উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ্যবাদ। আমরা অনেকেই জানি না যে ‘অসুর’ নামে বাস্তবে এক উপজাতি আমাদের দেশে এখনও আছে। তারা এখনও ঝাড়খণ্ডের কিছু অঞ্চলে এবং পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা। মহীশূরের বিভিন্ন জায়গাতেও শহর থেকে দূরে বিক্ষিপ্ত ভাবে বসবাস করে তারা। ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই অসুর জাতির সদস্যসংখ্যা ছিল ৪০০০-এর কিছু বেশি। এমনকি আলিপুরদুয়ারে একটা আস্ত গ্রামের নামই অসুর গ্রাম। অতি আশ্চর্য এবং একই সঙ্গে দুঃখের বিষয়, বিখ্যাত মণ্ডল কমিশন রিপোর্টে প্রকাশিত যে তফশিলি জনজাতিদের তালিকা আছে, তার প্রথম জনজাতিই ‘অসুর’, অথচ এ কথা এত কম লোক জানেন।
লোককথা অনুসারে, এই অসুর জাতি তাদের মহান রাজা ‘মহিষাসুর’ বা ‘ঘোরাসুর’-এর অন্যায় নিধন মেনে নিতে পারেনি। নিরীহ আদিম অধিবাসীদের উপর বহিরাগত আর্যদের আক্রমণ নেমে আসে। আদিবাসীদের বসবাস করার জায়গা ও মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি করা চাষের জমি তারা দখল করে নিতে এসেছিল। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বহিরাগত আর্যশক্তি দৈহিক দিক থেকে বলীয়ান না হলেও বুদ্ধির দিক থেকে ছিল অনেক বেশি উন্নত। তাই বার বার যুদ্ধ করেও যখন তারা আদিম অধিবাসীদের বিরুদ্ধে এঁটে উঠতে পারল না, তখন কূটকৌশল প্রয়োগ করে তারা জয়লাভ করে। বীরের যুদ্ধ থেকে সরে এসে তারা ভূমিপুত্রদের দুর্বল জায়গাটি অবশেষে খুঁজে বার করে। দেখে যে, আদিম জাতির সমাজে মহিলাদের স্থান অনেক উপরে; তারা সম্মাননীয়া, তারা পূজিতা। (আজকের দিনেও খেড়ওয়াল আদিবাসী যেমন সাঁওতাল, মুন্ডা বা ওরাওঁ জনজাতিদের মধ্যে পণপ্রথা প্রচলিত নেই— তাদের বরযাত্রীরা কনের বাড়িতে গিয়ে নিজেরাই রান্না করে খায়।) আর্যরা তাই মহান বীর মহিষাসুর বা ঘোরাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এক নারীকে প্রেরণ করেছিল। তারা ভাল ভাবেই জানত, আদিম জনজাতিদের প্রথা অনুযায়ী মহিষাসুর কখনওই নারী বা শিশুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না। সুযোগ বুঝে তাই সেই নারীকে কান্ডারি করে অনার্যদের মহান নেতা মহিষাসুর এবং এখানকার ভূমিপূত্রদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করে তারা। এই রকম অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এক দিন ভূমিপুত্র আদিবাসী খেড়ওয়ালরা তাদের ক্ষমতা হারায়, যে দুঃখ আজও তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙালি উচ্চবর্ণীয় নাগরিক সমাজ যখন দুর্গাপূজায় মেতে থাকে, অসুরদের বিনাশ চায়, আলিপুরদুয়ারে অসুর প্রজাতির লোকেরা নিজেদের কুঠুরিতে আবদ্ধ রাখে পূজার কয়েকটা দিন।
অন্য দিক দিয়ে ভাবতে গেলে বোঝা যায়, যে মহিষাসুর ওতপ্রোত ভাবে মহিষের সঙ্গে জড়িত (মহিষকেই মহিষাসুরের বাহন হিসেবে দেখানো হয়), গ্রামীণ কৃষিপ্রধান সভ্যতার বাহক অনার্য জাতির কাছে সে খুব আপন হবেই। তাই দুর্গাপূজার পনেরো দিন পরেই আদিম অধিবাসীদের দ্বারা পালিত বাঁদনা পরবে গৃহপালিত পশু হিসেবে মহিষের পূজা বা বন্দনা হয়। ভাবতে অসুবিধা হয় না, কেন গ্রামবাংলাতে আদিবাসীদের কাছে মহিষাসুর নায়ক হতে পারেন।
উল্টো দিকে, নাগরিক উচ্চবর্ণীয় সমাজ বা আর্য সমাজে অসুর জাতি মানেই ‘অ-সভ্য’ জাতি। অভিনব বাংলা অভিধানে ‘সাঁওতাল’ শব্দের অর্থও এই ভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘সাঁওতাল পরগনার আদিম অধিবাসী; অসভ্য জাতিবিশেষ’। যে ‘দুর্গা’কে কেন্দ্র করে এত ধুমধাম, তিনিই বা কে? অসভ্য জাতি বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়, তাদের সমাজে দুর্গা নামে কোনও মহিলা নেই। দুর্গাকে তারা পুংলিঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করে, এবং তাদের ছেলেদের নামকরণ করা হয় দুর্গা নামে। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এই জাতির লোকেরা তাদের নায়ক মহিষাসুরকেই ‘হুদুড় দুর্গা’ বলে ডাকে।
এই যে বিচিত্র ঐতিহ্য আমাদের রাজ্যেরই সংস্কৃতির মধ্যে লুকিয়ে আছে, নাগরিক উচ্চবর্ণীয় সমাজ কি কোনও দিন তার কথা শুনতে চায়? না। এই সব সংস্কৃতিকে দমিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা চলছে সেই আদিকাল থেকেই। ‘বৈচিত্রের মধ্যে একতা’ ইত্যাদি আমরা মুখে বলি, কিন্তু সংস্কৃতির বিচিত্রতার ধারা আমরা রক্ষা করে চলি না, এমনকি তাদের ন্যূনতম সম্মানও রক্ষা করি না। কে বলতে পারে এই বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা বা তাদের কথা না-শোনার ফলেই উল্টো দিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ, হিংসাবাদী ইত্যাদির উত্থান হয়নি? ছত্তীসগঢ়ে তো আজও মাওবাদী দমনের নামে চলে আসছে আদিবাসীদের উপর নির্যাতন।
নাগরিক সমাজ যখন তাদের শারদীয়া পূজায় আনন্দে মাতে, তখন তাই দুর্গার এই অন্য ঐতিহ্যটিও স্মরণে রাখা জরুরি। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে জয়ধ্বনি দিয়ে, এবং তাকে উপলক্ষ করে ‘অসুর’ নামক একটা আদিবাসী সম্প্রদায়ের বুকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ না করাটা জরুরি। আদিম অধিবাসীরা হয়তো বলবেন, আপনাদের শারদীয়ার আনন্দ আমরা কেড়ে নিতে চাই না, কেবল পদতল থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক আমাদের মহান নেতা মহিষাসুরকে। প্রসঙ্গত, আজও ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত খেড়ওয়াল আদিবাসীর (মূলত সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি জাতি) পুরুষরা সেরেঞ বা ভুয়াং হাতে ‘দাঁশাই নাচ’-এর মাধ্যমে নিজেদের আত্মরক্ষার একটা প্রয়াস করে। তাদের ‘হায় রে! হায় রে!’ আর্তনাদে, তাদের মহান নায়কের বীরগাথার মধ্যেই হয়তো প্রকাশিত হয় মানুষ হিসেবে তাদের নিজেদের সুগভীর বঞ্চনা ও অবহেলার ক্ষোভ!
গণতান্ত্রিক দেশে যে আজও আদিবাসী মানুষ তাদের নিজেদের সংস্কৃতির মর্যাদা না পেয়ে ক্ষুব্ধ, এ আমাদের দেশেরই লজ্জা। সংবিধানিক অধিকার তাদেরও জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু মানবিক মর্যাদা তারা এখনও পায়নি, এই এক মহিষাসুর বৃত্তান্ত থেকেই তা বোঝা সম্ভব। আমরা যেখানে সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে থাকার গর্বে আটখানা, সেখানে আমরা কি পারি না, আমাদের পার্বণের নামে আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে আঘাত না করতে? তাদের কোনও ভাবে অপমান বা অসম্মান না করতে? যদি পারতাম, আমাদের পার্বণই হয়তো শুদ্ধতর হতে পারত। আরও শুভও হতে পারত।