মোগল বাদশাদের মতো বাংলার বেশিরভাগ নবাব ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী। মোগলদের মতোই কণ্ঠসঙ্গীতের পাশাপাশি যন্ত্রসঙ্গীতও ছিল বাংলার নবাবি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাজধানী মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তে নবাবি বাদ্যকরেরা সকাল, সন্ধ্যে এবং রাতে নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য থাকত আলাদা কক্ষ যা পরিচিত ছিল ‘নহবতখানা’, ‘নওবতখানা’ বা ‘নক্করখানা’ নামে। নহবতখানা বা নক্করখানা বলতে ‘ঢাক বা ডঙ্কা ভবন’ বা ‘বাদ্যঘর’ বা ‘যন্ত্রসঙ্গীত ভবন’ বোঝাত। মোগল স্থাপত্য শিল্পে নহবতখানা বা নক্করখানাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হত। নহবতখানা এবং নক্করখানা শব্দ দু’টি আলাদা হলেও এর অর্থ প্রায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। নক্করখানার থেকে নহবতখানা নামটি জনপ্রিয় ছিল বেশি।
নহবতখানায় ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলি ছিল ‘নাক্কারা’ বা ‘ডঙ্কা’, ‘কুয়ার্গা’ বা ‘দামামা’, ‘দুহুল’ বা দুমুখো ঢোল। ‘কর্না’ যা দেখতে সানাইয়ের মতো হলেও এটি সানাইয়ের থেকে বড় আকৃতির একটি বাদ্যযন্ত্র যা সোনা, চাঁদি, পিতল-সহ আরও নানা ধাতু দিয়ে নির্মিত হত। ‘সুরনা’ দেখতে এবং আকারে সানাইয়ের মতো হলেও এর আওয়াজ সানাইয়ের থেকে কিছুটা পৃথক।
এ ছাড়াও ছিল ‘নাফির’ নামে পিতল নির্মিত এক বাদযন্ত্র যেটি দেখতে অনেকটা অনেকটা ‘কর্না’-এর মতো। এগুলির সঙ্গে থাকত পিতলের নির্মিত শিঙা যা দেখতে অনেকটা গরুর শিঙের মতো। এবং আরও থাকত সাঞ্জ বা ঝাঁঝ। এই ঝাঁঝ বা ঝাঁঝর পিতলের তৈরি একটি বাদ্যযন্ত্র যেটি অনেকটা থালার মতো দেখতে। প্রতিটি বাদ্যযন্ত্র বেশ কয়েক জোড়া এক সঙ্গে বাজানো হত। কণ্ঠসঙ্গীতের জন্য থাকত পৃথক বাদ্যযন্ত্র এবং পৃথক বাদ্যকর।
নবাবি আমলে শহরের মূল প্রবেশ পথে, কেল্লার প্রবেশ পথে, নবাবের প্রাসাদের প্রবেশের পথে এবং প্রাসাদের ভিতরেও থাকত যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য একটি নির্দিষ্ট কক্ষ। মোবারক-উদ-দৌলার প্রাসাদ ছিল সবার থেকে আলাদা। প্রাসাদে ছিল সাদা মার্বেল পাথরের নির্মিত চমকপ্রদ খিলান বিশিষ্ট স্তম্ভ। সেখানে নানা রঙের পর্দা লাগানো থাকত। প্রাসাদের খিলানে বসে দেশীয় বাদ্যকরেরা প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় সুমধুর যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন।
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাঁদনি চকের কাছেই নবাব সুজাউদ্দিনের প্রাসাদের মূল প্রবেশ পথের তোরণের উপরিভাগে, মতিঝিলের ঘসেটি বেগমের প্রাসাদ সাঙ্গ-ই-দালানের প্রবেশ পথের তোরণের উপরে, হিরাঝিলে সিরাজের মনসুরগঞ্জ প্রাসাদের প্রবেশ পথের তোরণের মাথায় এবং প্রাসাদের ভিতরে, জাফরাগঞ্জে মিরজাফরের বাড়ির মূল প্রবেশ পথের তোরণের মাথায় এবং মুর্শিদাবাদের কদমশরিফে প্রবেশের মূল প্রবেশ পথের তোরণের উপরে নহবতখানা ছিল। মুর্শিদাবাদের নিজামত ইমামবাড়াতেও ছিল একটি নহবতখানা। এ ছাড়া চাঁদনি চকে নবাব সুজাউদ্দিন নির্মিত ত্রিপলিয়া তোরণ এবং মুর্শিদাবাদের কেল্লা নিজামতে প্রবেশের প্রধান তোরণের উপরেও ছিল বড় ও সমৃদ্ধ নহবতখানা। যেখানে বছরের অন্য সময় সকাল, সন্ধ্যা এবং মধ্যরাতে এবং কোনও উৎসব বা ছুটির দিন প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশিত হত।
নহবতখানার যন্ত্রসঙ্গীতে নবাবের প্রতিপত্তি ও আভিজাত্য প্রকাশ পেত। সমৃদ্ধ নহবতখানা নবাবের সম্মান বৃদ্ধি করত। কখনও নবাবের সম্মানে, কখনও নবাবের রাজকীয় অতিথিদের বরণ করতে নহবতখানা থেকে পরিবেশিত হত যন্ত্রসঙ্গীত। এ ছাড়াও নবাব পরিবারের যে কোনও ধর্মীয় কিংবা সামাজিক উৎসবে নহবতখানার যন্ত্রসঙ্গীত ছিল অপরিহার্য। এ ছাড়াও নবাব যখন জুলুশ বা মিছিল সহযোগে বাইরে বেরোতেন তখন সেই জুলুশে নবাবি বাদ্যকরেরা থাকতেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সৈন্য দীন মহম্মদ এক বার নবাব মুবারক-উদ-দৌলার শাসনকালে মুর্শিদাবাদ শহরে এসে নবাবের এক রাজকীয় আভিজাত্যে ভরপুর এক জুলুশ বা মিছিলের সাক্ষী ছিলেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতায় লিখেছেন যে, সেই রাজকীয় মিছিলে ছিল দেশীয় বাদকদের একটি দল। বাদকদের সঙ্গে থাকা একটি উটের পিঠে ছিল বিরাট আকারের একটি ঢোল। বহু দূর থেকেও যার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
নহবতখানায় শুধুমাত্র আনন্দের মুহূর্তই নয়, শোকের মুহূর্তগুলোও যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতেন বাদ্যকরেরা। বিশেষ করে মহরমের সময় মুর্শিদাবাদের নিজামত ইমামবাড়ার নহবতখানা এবং চাঁদনি চক বাজারের ত্রিপলিয়া তোরণের উপরের নহবতখানা থেকেও বাজানো হত করুণ সুর। এ ছাড়াও নবাব-সহ নিজামত পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কোনও সদস্যের মৃত্যুযাত্রাতেও বাদ্যকরেরা বাদ্যযন্ত্রে শোকের সুর তুলতেন। ১৮২১ সালের ৬ অগস্ট। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সুবাদার সুজা-উল-মুলক, মুবারক-উদ-দৌলা, আলি জা, ফিরোজ জং, নবাব নাজিম জাইনউদ্দিন আলি খাঁ দেহত্যাগ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ৭ অগস্ট বহরমপুর থেকে কোম্পানির সিপাইরা দু’টি তোপ নিয়ে নবাব প্রাসাদের সামনে উপস্থিত হয়। অন্য দিকে নবাবের দেহ ধুয়ে সবুজ কাপড়ে ঢেকে পালঙ্কে উঠিয়ে সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হয়। এই শোক যাত্রার সামনের সারিতে বন্দুক উঁচিয়ে সিপাইরা ছিল। সঙ্গে কালো কাপড়ে ঢাকা বাদ্যযন্ত্রে করুণ সুর বাজাতে বাজাতে এগিয়ে চলেছিলেন বাদ্যকরেরা।
জনগণের প্রতি নবাবের কোনও আদেশ জারি হলে সেই আদেশ ঘোষণা করার ক্ষেত্রেও বাদ্যকরদের গুরুত্ব ছিল অনেক। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নাক্কারা বা ডঙ্কা বাজিয়ে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে নবাবি আদেশ প্রচার করা হত। নবাবি সেনা বাহিনীতেও বাদ্যকরদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। তাঁরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সৈন্যদের উজ্জীবিত করতেন। এ ছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্রে নানা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মনে ভয়ের সৃষ্টি করত।
পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার মসনদে বসেন নাজাফি বংশের শাসকেরা। এই বংশের প্রায় সমস্ত নবাবই সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন। নাজাফি বংশের প্রথম দিকের নবাবদের আমলে বাদ্যযন্ত্র এবং যন্ত্রসঙ্গীতের পূর্ব ঐতিহ্য বজায় ছিল। কিন্তু উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে বাদ্যযন্ত্র এবং বাদ্যসঙ্গীতে অনেকটাই ইংরেজি প্রভাব পড়ে। নহবতখানায় দেশীয় বাদ্যকরেরা তো ছিলেনই। সেই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরেরা বিদেশি যন্ত্রসঙ্গীতেরও ব্যবস্থা করতেন। আনাতেন ইংরেজ বাদ্যকরদের দল। সেই সঙ্গে কেল্লা নিজামতের ভিতরে তৈরি করেছিলেন বেশ কয়েকটি ‘ব্যান্ড স্ট্যান্ড’। নবাবের সঙ্গে কোনও ইংরেজ আধিকারিকের বৈঠক থাকলে ইংরেজ বাদ্যকরেরা সেই ব্যান্ড স্ট্যান্ডে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নানা সুর তুলতেন।
কালের নিয়মে নহবতখানার জৌলুসও ধীরে ধীরে কমে এসেছিল। পূর্বের সেই সব বাদ্যযন্ত্রও তেমন ছিল না। বিংশ শতকের সত্তরের দশকের প্রথম দিকেও প্রতিদিন সকাল, সন্ধ্যায় বাদ্যকরেরা যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তাঁদের পরনে থাকত খাকি রঙের শার্ট, হাফপ্যান্ট এবং মাথায় থাকত লাল পাগড়ি। এই বাদ্যকরেরা দক্ষিণ দরজার কাছেই বাস করতেন।
আজ মুর্শিদাবাদের নবাব থাকলেও নেই সেই নবাবিয়ানা। বহু প্রাসাদ, তোরণ আজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে নহবতখানাগুলিও। এখন মুর্শিদাবাদে যে অল্প কয়েকটি নহবতখানা রয়েছে সেগুলিও স্মৃতি আঁকড়ে ধ্বংসের প্রহর গুনছে। নবাবি আমলে নহবতখানা থেকে ভেসে আসত সুর। আর এখন সেখান থেকে ভেসে আসে শুধুই হাহাকার।