বৃথা চিন্তা

ইদানীং আসিয়াছে নূতন বিলাপ: হায়, সিনেমার দিন গিয়াছে, আন্তর্জাল আসিয়া সিনেমাকে বাতিল করিয়া দিল। ওয়েব-সিরিজ নির্মিত হইতেছে, ইউটিউবে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি তৈয়ার হইতেছে, একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ উঠিয়া যাইতেছে, মাল্টিপ্লেক্সগুলি কেবল বিশাল বাজেটের চমক-সমন্বিত বা তারকাখচিত ছবিকে স্থান দিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

প্রতীকী ছবি।

কিছু দিন পূর্বেও শিল্পরসিকরা হাহাকার করিতেন, গ্রন্থের দিন গিয়াছে। মানুষ কেবলই সিনেমা ও টিভির প্রতি ঝুঁকিয়া পড়িতেছে, প্রত্যক্ষ দৃশ্য ও ধ্বনি আসিয়া মুদ্রিত অক্ষরের মহিমাকে ‌ম্লান করিয়া দিয়াছে। ইদানীং আসিয়াছে নূতন বিলাপ: হায়, সিনেমার দিন গিয়াছে, আন্তর্জাল আসিয়া সিনেমাকে বাতিল করিয়া দিল। ওয়েব-সিরিজ নির্মিত হইতেছে, ইউটিউবে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি তৈয়ার হইতেছে, একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ উঠিয়া যাইতেছে, মাল্টিপ্লেক্সগুলি কেবল বিশাল বাজেটের চমক-সমন্বিত বা তারকাখচিত ছবিকে স্থান দিতেছে। মানুষ ক্রমে ব্যক্তিগত বিনোদনের পানে ঝুঁকিতেছে। সকলে নিজ মোবাইল বা কম্পিউটারে বসিয়া নিজ পছন্দ সময় রুচি মেজাজ অনুযায়ী ছবি দেখিতেছে, কখনও উঠিয়া গল্প করিতে যাইতেছে বা বাজার সারিয়া আসিতেছে, ফিরিয়া পুনরায় দেখিতে শুরু করিতেছে। সিনেমা বলিতে মানুষ যাহা বুঝিত, প্রেক্ষাগৃহে অনেকে মিলিয়া বসিয়া এক মনোযোগী সমষ্টিগত আচার পালন, তাহা আর ফিরিবে বলিয়া মনে হইতেছে না। পণ্ডিতেরা বলিতেছেন, এই নূতন প্রবণতা চলচ্চিত্রের সকল গুরুত্ব কাড়িয়া তাহাকে পলকা অগভীর মাধ্যমে পরিণত করিতেছে। সিনেমা আজ মৃত। তাহার শবের উপর দাঁড়াইয়া ওয়েব-সংস্কৃতি আট্টহাস্য করিতেছে।

Advertisement

হাহাকার করা মানুষের প্রাচীন অভ্যাস। গ্রন্থ আসিয়া কথকতাকে দূরে হটাইয়াছিল, সিনেমা আসিয়া গ্রন্থকে ধাক্কা দিয়াছিল। যুগে যুগে মানুষ এক শিল্পমাধ্যম হইতে অন্য মাধ্যমের দিকে ছুটিয়া গিয়াছে। ১৮৯৬ সালে, যখন লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় একটি পরদায় দেখাইয়াছিলেন একটি ট্রেন স্টেশনে ঢুকিতেছে, কথিত আছে, দর্শকেরা পড়িমরি করিয়া ছুটিয়া পলাইয়াছিল। এমন অভিঘাত হানিবার সাধ্য পৃথিবীর কোন লেখকের কোন বাক্যের রহিয়াছে? আবার মোবাইলেই যদি চলচ্চিত্র চলিয়া আসে, কেহ যদি বিমানবন্দরে অপেক্ষা করিবার সময় অনায়াসে চলচ্চিত্রটি দেখিয়া লইতে পারেন, কেন তিনি টিকিট কাটিয়া প্রেক্ষাগৃহে যাইবেন? মানুষ চির কাল সুবিধা, আরাম, সহজতা ভালবাসে। এক কালে সিনেমা দেখিতে যাওয়া এক আশ্চর্য উৎসব ছিল। কারণ তাহা ছিল বিরল। এখন পেন ড্রাইভের দৌলতে, কিংবা স্ট্রিমিং (চাহিদা প্রকাশ করিবামাত্র সরাসরি প্রদর্শন শুরু হইবার প্রক্রিয়া) আসিয়া গিয়া, দর্শকেরা ‘বিঞ্জ-ওয়াচিং’ করিতেছে, যাহার অর্থ, এক ধারাবাহিকের দশটি কি বারোটি এপিসোড বিরতিহীন ভাবে দেখিয়া যাওয়া। কোনও রক্ষণশীল চলচ্চিত্রকার বা চিত্রপণ্ডিত এই অভ্যাসকে শংসাযোগ্য মনে করিবেন না, কারণ গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কোনও পপকর্ন নহে, যাহা বিনা চিন্তায় বিনা বিশ্লেষণে নিরন্তর ভোগ করিয়া যাইলেই হইল। কিন্তু মুশকিল হইতেছে, প্রযুক্তি পালটাইলে, বিনোদন ও সৃষ্টির যুক্তিও পালটাইবে। প্রবণতাও পালটাইবে। যেমন নূতন ধরনের শিল্প আসিয়া পুতুলনাচকে প্রায় নাশ করিয়া দিল, পুতুলনাচে শ্রেষ্ঠ চিন্তন ও প্রয়োগ আসিলেও তাহা আর সিনেমার জন-আবেদনের সমীপবর্তী হইতে পারিবে না, তেমনই দৃশ্য-শ্রাব্য শিল্প মানুষের এমন অভূতপূর্ব অনায়াসায়ত্ত হইয়া, পূর্বের সিনেমা-ধারণাকে উড়াইয়া দিতেছে।

কিন্তু তাহাতে সিনেমার মৃত্যুর দ্যোতনা নিহিত নাই। তাহার অন্য রূপে জন্ম হইতেছে। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হইবার অর্থ সিনেমার বিনাশ কেন হইবে? মোবাইলে সিনেমা দেখিলে কি তাহা সিনেমা নহে? বড় পরদার আবেদন হয়তো সেই সিনেমা হারাইবে, কিন্তু বালিশে শুইয়া ভোক্তা তাহাকে দেখিতেছেন, সেই অভাবনীয় ঘনিষ্ঠতা তো সে অর্জন করিবে। সর্বোপরি, এই নূতন যুগে, সিনেমা বলিতে আমরা যাহা বুঝি তাহা হয়তো বিলুপ্ত হইবে, কিন্তু একই সঙ্গে, সিনেমা করিবার জন্য সকল যুগে যে বিশাল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হইয়াছে, তাহাও লোপ পাইবে। কেহ নিজের মোবাইলেই সিনেমা তুলিয়া, তাহা সম্পাদনা করিয়া, আন্তর্জাল-ক্ষেত্রে উহাকে আপলোড করিয়া দিবে। যেমন কাগজ সস্তা হইয়া এক সময় সাহিত্যে বহু মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিয়াছিল, টিউশনির অর্থে অণুপত্রিকা বাহির করিয়া নিজ কাব্য জনসমক্ষে পৌঁছানো যাইত, তেমনই, কেবল ধারণা ও উদ্যম সম্বল করিয়া বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ করা সহজ হইবে, তাহা প্রদর্শন করিতেও কাহারও শরণাপন্ন হইতে হইবে না। নূতন সিনেমার দিন আসিতেছে, যাহা প্রযোজক পরিবেশকের তোয়াক্কা না করিয়া স্বাধীনতর মাধ্যম হইয়া উঠিবে।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

দিল্লির ভয়াবহ ধোঁয়াশার একটা কারণ, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা হুহু বাড়ছে। কলকাতা মুম্বই বেঙ্গালুরুর ট্র্যাফিক জ্যামেরও একটা বড় কারণ তা-ই। আর লোকে যে এত গাড়ি কিনছে তার বড় কারণ: ইএমআই। আগে, বিস্তর টাকা থাকলে, তবে বিলাসী হওয়া যেত। এখন সবাই বড়লোক-বড়লোক খেলছে। এক টাকা দিয়েও গাড়ি কিনে চড়তে শুরু, মধ্যবিত্ত হয়েও ফ্ল্যাটের মালিক। এত সাম্যবাদ ধর্মে সয়? এখন দিল্লি থেকে পালাতে প্লেনের টিকিট প্রায় এক লক্ষ টাকা। ইএমআই নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement