বাসন্তী থানার মাঝেরপাড়ায় বছর ছয়েকের এক শিশুকন্যাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে চম্পট দেয় পাড়ার যুবক। দিল্লিতে পথের ধারে আবর্জনার গাদায় সাত বছরের এক মেয়ের দেহ উদ্ধার হয়েছে। শিশুটি ১০ দিন ধরে নিখোঁজ ছিল। তদন্তে জানা গিয়েছে, শিশুটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। তেলঙ্গানার ওয়ারাঙ্গলের হানামকোন্ডায় নয় মাসের এক শিশুকন্যাকে অপহরণ করে তাকে ধর্ষণ করে টুঁটি টিপে খুন করার অভিযোগ উঠেছে মদ্যপ এক যুবকের বিরুদ্ধে। লোকসভা ভোট চলাকালীন হিমাচলপ্রদেশের কুলু এলাকার এক পোলিং বুথের কাছে এক লম্পটের লালসার শিকার হয় ন’বছরের এক মেয়ে। এ তো মাত্র কয়েকটি উদাহরণ। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি সাত থেকে বারো বছর বয়সি বাচ্চারা। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছে, শিশুদের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে ঘরের ভেতরে, আপনজনদের মাধ্যমে। প্রায় প্রতি দিন। শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে ঘটনার বীভৎসতার গভীরতা মাপা যাবে না।
সংবাদে প্রকাশ, চলতি বছরের প্রথম ছ’মাসে আমাদের দেশে ২৪ হাজারের বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নির্দেশক্রমে গোটা দেশে শিশুধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রধান বিচারপতি শীর্ষ আদালতের রেজিস্ট্রারকে এ নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন। শিশুধর্ষণের যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে, তাতে শীর্ষে আছে উত্তরপ্রদেশ। সেখানে গত ছ’মাসে ৩,৪৫৭টি শিশুধর্ষণ ঘটেছে। উত্তরপ্রদেশের পরেই আছে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান আর মহারাষ্ট্র। ১,৫৫১টি শিশুধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে আমাদের রাজ্য পঞ্চম স্থানে।
শিশুধর্ষণ একটি অসুস্থ প্রবণতা। চূড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়ের প্রকাশ। সমাজে অস্থিরতা, রাজনীতিতে হিংসার বহিঃপ্রকাশ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ যখন তৈরি হয়, তখন এ ধরনের অবক্ষয়ের প্রবণতা বাড়ে। আমাদের মধ্যে বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে, এই ধরনের ঘটনা বেড়ে যাওয়া সেটিরই প্রতিফলন। এই পরিস্থিতিতে ধর্ষণ-সহ নানা অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যায়। অন্য দিকে, সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার, মাদকাশক্তি, শিশু কিশোরদের আচরণগত সমস্যাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় এমন ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। বার বার শুনতে শুনতে পড়তে পড়তে এমন বর্বরোচিত ঘটনাও আমজনতার গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে।
কন্যাশিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা বর্তমান ভারতে একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যতই সরকার প্রচার করুক না ছেলে মেয়ে সমান, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাম্যের তুলাদণ্ডে বার বার প্রমাণ করে দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের পাল্লা এখনও কতটা হালকা। সাম্যের আকাশে পৌঁছনো দূরস্থান, মেয়েদের অস্তিত্বই আস্তে আস্তে বিপন্নতর হচ্ছে। অথচ মেয়েদের ক্ষমতা ও অবস্থানে বৈষম্যের যে মানসিকতা, সেটা দূর না হলে যৌন নির্যাতনের শিকড়ও ছড়াতে থাকবে। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের অর্থ কী, যদি লিঙ্গবৈষম্যের অস্বচ্ছতা দূর না হয়ে এই ভাবে গভীরতর হয়?
এই বিষয়ে পুরুষদের ভূমিকা জোরদার হওয়া দরকার। কেবল সচেতনতা নয়, তাদের সরবতাই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। কেবল নারীর সচেতনতায় এই সামাজিক মারণরোগ নিরাময় করা যাবে না। বিশেষ করে বাড়িতে ছোট ছেলেদের শেখানো দরকার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান করাটা কেন জরুরি। আমরা কেবল ভাবি, স্কুল পর্যায়ে বালিকাদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো বাধ্যতামূলক হলেই অনেকটা এগোনো যাবে। কিন্তু বালকদের মূল্যবোধশিক্ষা কি তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়? পাঠ্যক্রমে জীবনশৈলী পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে আর টালবাহানা করা উচিত নয়। যৌনশিক্ষা ও মূল্যবোধশিক্ষা একই সঙ্গে হলে তবেই হয়তো পড়ুয়াকে উপযুক্ত সংবেদনশীল দায়িত্ববান নাগরিক তৈরি করা যাবে।
সম্প্রতি পাশ হওয়া পকসো বিলকে স্বাগত জানিয়েও একটা কথা বলতে হয়। শিশুধর্ষণ রোধে কড়া শাস্তির দাবি সঙ্গত ঠিকই। কিন্তু শাস্তিতেই কি এই ব্যাপ্ত সামাজিক বিকার ঘুচবে? এ দেশে শিশুধর্ষণ রোধে গরু পুজোর কথাও শোনা গেল সম্প্রতি— তেলঙ্গানার হায়দরাবাদে চিলকুর বালাজি মন্দিরে। আজব এই দুনিয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে ডিজিটাল ইন্ডিয়া আসলে কী দিয়ে তৈরি। সংখ্যা দিয়ে সভ্যতার অনেক সূচকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু যত ক্ষণ না এ ধরনের সামাজিক রোগের নিরাময় হচ্ছে, তত ক্ষণ আমরা নিজেদের সভ্য দাবি করতে পারি না। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রথম কাজ। কিন্তু কেবল রাষ্ট্র নয়। পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের দায়িত্বও অনেক।
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।