ছবি: সংগৃহীত
মাঝেমধ্যে মনে হয় ‘ভালবাসা’ শব্দটির কাছাকাছি আর অন্য কোনও শব্দ বর্ণমালা এমন মায়ায় তৈরি করতে পারেনি। কেমন যেন দু’হাত দিয়ে ঘিরে রাখা আদর আছে এ শব্দে! ‘ভালবাসি’ উচ্চারণ করায় যে আলো ঠিকরে বেরোয়, নম্র অথচ দৃপ্ত সেই অলৌকিক আলোর ভিতর একই সঙ্গে নিজের আর ভালবাসার মানুষটির দু’জনেরই শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়। আমি ভালবাসি আর তোমার ভালয় বাস করি আমি! তোমার ভালটিকে চিনে নিয়েছি দেখ ঠিকঠাক! সেই সুরে জলে-স্থলে-কাছে-দূরে সত্যিই বাঁশি বেজে ওঠে! সে বাঁশি চিরকালীন যমুনার দিক থেকেই হোক বা আরশিনগরে বরাবর থেকে যাওয়া ভবঘুরে কাঙালের বুকের ভিতর থেকে উৎসারিত হোক!
যে কাঙাল নিজেকে খুব ইট, কাঠ, পাথরের প্রযুক্তির জেনে অথবা বাস্তব পৃথিবীর হিংসা ঘৃণা, ঈর্ষাকাতরতায় মুখ ফিরিয়ে বসে আছে নিজের থেকেই আর অভিমান শব্দটিকে খুব অস্বস্তির মনে করে ভুলে যাওয়া অভ্যেস করে যাচ্ছে দৈনন্দিনে— তার অবচেতনেও কি এই ফাল্গুনবাতাস অন্যমনস্ক সুরটি বাজায় না আনমনে? প্রতিটি মানুষ কোথাও না কোথাও তার প্রেমের সত্ত্বাটিকে সংগোপনে বয়ে নিয়ে যায় নিজের ভিতর। এর কোনও ক্যালেন্ডার, বয়ঃক্রম বা বংশলতিকা কিচ্ছুটি থাকতে পারে না।
প্রতিটি দিনই প্রেমের, ভালবাসার, উদ্যাপনের— এ কথা আমরা বলেই থাকি। কিন্তু সত্যি কি বিশ্বাস করি মনেপ্রাণে সবাই? ‘দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর/ভালবাসিবারে দে আমারে অবসর’ বলে উঠতে হয় কেন তবে কবিকে? কারণ, এই চীৎকৃত পৃথিবীতে, এই ঘৃণা আর সন্দেহের দুনিয়ায়, এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে সত্যিই ভালবাসতে ভুলে যাচ্ছি আমরা! বড় বেশি বারুদের গন্ধ, বড় ঘন সন্দেহের কুয়াশা। তেমন করে ভালবাসতে পারলে সত্যিই বুক থেকে লাল-নীল পাথর খসে যায়। এক জীবনে জন্মান্তর ঘটে যায় সহস্র জন্মের। শুধু ভালবাসায় ভর করে হাঁটা যায় যোজনপথ। ভালবাসা এই চতুঃবর্ণে বর্ণমালা শেষ হয়ে যায়। প্রতিটি নারী অথবা পুরুষ তখন নিজের মতো করে এক চিরন্তন রাধিকা বা বনমালী। এত যে গভীর এক অনুভব, তার উদ্যাপন থাকবে না আমাদের যাপনে? ভালবাসা ক্ষমাপ্রবণ করে তোলে, শান্ত করে অস্থিরতা অতিক্রম করতে পারলে। অবগাহনের স্থির নীরবতা দেয়। বেঁচে থাকা রমণীয় করে তোলে দু’দণ্ড। আমাদের সমস্ত শিল্পপ্রকাশই কোনও না কোনওভাবে এই প্রেম-ভালবাসা কাঙালপনা আকুতি চাওয়া-পাওয়া হারানো— এই সমস্তকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। অথচ ‘ভালবাসি’ কথাটি সে ভাবে বলে ওঠা হয় না অনেকেরই। প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু, মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন বা নামহীন অজস্র সম্পর্কের সুতোয় টান পড়ে কতবার! বলে ওঠা হয় না— ভালবাসি, সত্যিই ভালবাসি! ‘ভালবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ বলে পরম অভিমানী মানুষ একা একা নৈঃশব্দ্যে ডূবে যান কোথাও। কখনও অনন্ত অপেক্ষায় উপেক্ষার ছায়াপাত একলা বৃষ্টি নামায় আর ক্রমশ দূরের দ্বীপ হয়ে যায় কত সম্পর্ক। ভালবাসার কথা সে ভাবে বলে ওঠা হয় না।
তাই হয়তো অভিজ্ঞান খুঁজে নিয়েছে নতুন পৃথিবী। দিবসযাপনের ছুতো হয়তো বলিয়ে নিচ্ছে না-বলা বাণীর ঘনযামিনীর আড়ালের কথাটুকু কোনও বসন্তশেষের পথিককেও। যে কথা তার প্রথম ফাল্গুনে বলা হল না, সে কথা আজি যেন বলা যায়! এই প্রেমদিবসের হাত ধরে! তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার-! যদি বর্ষার গান গেয়ে বসন্তে ভালবাসা যায়, যাক না! অজস্র উচ্চারণের, উদ্যাপনের, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশিই চিরকাল নিভৃত, না-বলা, না বলতে পারা, অনুচ্চকিত থেকে যাওয়াটুকু নিজের গরিমায় আছে তো! থাকাতেই বাঙ্ময় সেটুকু। তবু সামান্য উপহার বা উচ্চারণ ভাললাগা বয়ে আনে---‘হোক ফুল, হোক তাহা গান’। বসন্ত প্রেমের ঋতু, এ কথা নিছক কবির অলস মস্তিষ্ক-প্রসূত নয় মোটেই। শীত শেষ হয়ে আসার জড়তামুক্তি ভিতর থেকেও বোধ হয় একটা অর্গলমুক্তির ডাক পাঠায়। এই সামাজিক মাধ্যম, আর বিজ্ঞাপনের বিস্ফোরণের দুনিয়ায় ভালবাসা নিছক পণ্যায়িত বলে যাঁরা রব তোলেন, তাঁরা হয়তো বিশুদ্ধবাদী এবং নিজেরাও অনুচ্চকিত দিনযাপনের পক্ষপাতীই। কিন্তু খুব নির্জনে নিভৃতে ভালবাসার কাঙাল একটা লাজুক মন যে তাঁদেরও আছে, যে মন লালন চায়, যত্ন চায়, শুশ্রূষা চায়, প্রেমের কাছে নতজানু হতে জানে, এ কথা বুকে হাত রেখে তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না।
প্রকাশের ভিন্নতায় সমস্তটাই হুজুগে পরিণত হয়ে হারিয়ে যাতে না যায়, তাতেই সতর্কতা কেবল। সেটুকু থাক, কিন্তু ভালবাসায় নিষেধ যেন না থাকে। ‘প্রেম’ শব্দে একই সঙ্গে যদি প্রেরণা আর মায়া জড়িয়ে নাই-ই থাকত, তবে তা এত এত সৃজনের পথ খুলে দিতে পারত কি না সন্দেহ হয়। প্রকৃত প্রেমের কাছে মানুষ অর্গলহীন ভাবে নিজের মুখোমুখি হতে পারে, নির্লজ্জের মতো। তার অস্তিত্বের সমস্তটা উন্মুক্ত হয়ে যায় নিজের কাছে— সবটুকু দৈন্য ও মহত্ত্ব নিমেষে খুলে দেয় দরজা-জানলা। এই প্রেম হারায় না কখনও, তা যাপনের অঙ্গ হোক বা না হোক। দৈনন্দিনতা তাকে মুছতে পারে না, বিচ্ছেদ তার ধ্বংস আনে না, দূরত্ব আবছায়ায় ঢাকে না।
এই সমস্ত শর্তে থাকা প্রেমের জন্যই উদ্যাপন জরুরি খুবি— নিজের মতো করেই। কথা বা নীরবতায়, উচ্চারণে বা নৈঃশব্দ্যে ঘৃণাটুকু সরিয়ে রেখে বাঁচা বড় প্রয়োজন এই পৃথিবীর। ভালবাসলে ক্ষতি নেই সত্যিই, শুধু পাওয়া আছে! কষ্ট পাওয়াও তো এক রকমের সেই পাওয়াইই! প্রতিবার মধুমাসে প্রকৃতি নিজের প্রেমে পড়ে নতুন করে। বসন্তে যে যৌবনযাপন, তা শুধু তো শারীরিক হতে পারে না! দিনশেষের রাঙা মুকুল বুকের ভিতর ফুটে থাকে কোন অলক্ষ্যে, তাকে খুঁজে নেওয়াও তো আজন্মের তপস্যা।
প্রেমের দিন প্রেমে দীন হওয়ার তুলনায় শ্রেয় বইকি! সমাজের সকল বিধি-নিষেধ-শর্ত-নিয়মাবলি এই একটি অনুভবের কাছে লুটিয়ে পড়েই তো চিরকাল সামান্যকে রাজাধিরাজের গরিমা দিয়েছে। ‘বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি’ দিয়ে যাবতীয় সম্পদ নস্যাৎ করে বেঁচে থাকার স্পর্ধায় শুধু ভালবাসার কাছে নতজানু একটা জীবনের চেয়ে আর কীই-বা আকাঙ্ক্ষিত হতে পারে! প্রেম আসলে একটা স্থির বোধ— কোথাও না কোথাও রয়ে যাওয়া একটা স্পর্শের জন্য, অনুভবের জন্য যা অনন্ত করে তোলে মুহূর্তকে।
আজ এই অন্ধকার সময়ে, এই গুলিয়ে যাওয়া পরিবেশ-পরিসরে ভালবাসা সেই জরুরি অনুভূতি, যা আমাদের সুস্থ করে তুলতে পারে, ভদ্র করে তুলতে পারে।
(লেখক ময়নাগুড়ির খাগড়াবাড়ি উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)