ছবি পিটিআই।
বহুদলীয় ব্যবস্থা কি দেশবাসীর লক্ষ্য পূরণ করিতে পারিয়াছে? এমন একটি প্রশ্ন বিতর্কসভার আলোচ্য বিষয় হিসাবে দিব্য চলিতে পারে। চলিয়া থাকেও। কিন্তু দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি প্রকাশ্যে এই সংশয় প্রকাশ করেন, চিন্তিত হইতেই হয়। বিশেষত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম যখন অমিত শাহ এবং তাঁহার দলের নাম: ভারতীয় জনতা পার্টি। এই দল বরাবরই একের ভক্ত। তাহাদের জাতীয়তার ধারণা প্রবল ভাবে একমাত্রিক, এবং তাহা লইয়া দলের নেতা ও অনুগামীদের কোনও সঙ্কোচ নাই, বরং গর্বই প্রবল। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সেই গর্ব প্রবলতর হইয়াছে। এই জমানা এক অর্থে বহুত্বকে খর্ব করিয়া ‘জাতীয়তাবাদী ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই সক্রিয়, যে জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগুরুবাদের নামান্তর। এমন একটি দলের প্রবল প্রতিপত্তিমান সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের জাঁদরেল (প্রসঙ্গত, শব্দটি ‘জেনারেল’ হইতে সঞ্জাত) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বহুদলীয় ব্যবস্থার কার্যকারিতা তথা যৌক্তিকতা লইয়া প্রশ্ন তুলিলে উদ্বেগ স্বাভাবিক। তিনি কি দেশ হইতে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে বিদায় জানাইবার প্রস্তাবনা করিতেছেন?
অস্বীকার করিবার উপায় নাই, দেশের বহু মানুষই এই প্রস্তাব সমর্থন করিবেন এবং আরও অনেকে বলিবেন, ‘সত্য সত্যই এত বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের পক্ষে বোঝা স্বরূপ, দলাদলিই তো দেশের অগ্রগতি রোধ করিতেছে।’ বহু দল, বহু মত, বহু স্বার্থের টানাপড়েনে অনেক সময়েই অস্থিরতা বাড়ে, নীতিনির্ধারণ এবং সরকারি প্রশাসনের গতি ও মসৃণতা ব্যাহত হয়। ইহা অনেক নাগরিকেরই বিরাগ উৎপাদন করে, তাঁহারা অসহিষ্ণু হইয়া ভাবেন, দলের সংখ্যা কম হইলে কাজ অনেক বেশি হইত, ভাল হইত। গত এক বা দুই দশকে, বিশেষত কেন্দ্রীয় স্তরে, নির্বাচনগুলির ফলাফলে এই মানসিকতার ছায়া পড়িয়াছে, কোনও একটি দল বা জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের হার বাড়িয়াছে। বস্তুত, নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে এই প্রবণতার ভূমিকা অনেকখানি। অনুমান করা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাহা জানিয়া এবং বুঝিয়াই তাঁহার সংশয়ের ঘুড়িটি উড়াইয়াছেন।
সেই কারণেই তাঁহার উক্তি আরও বেশি উদ্বেগজনক। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতি বিরাগ খুব সহজেই গণতন্ত্রের প্রতি বিরাগে পর্যবসিত হইতে পারে। মানুষ সহজেই ভাবিতে পারেন— গণতন্ত্র বস্তুটিই যত নষ্টের গোড়া, বহু মতকে ‘প্রশ্রয়’ দিতে গিয়া তাহাই দেশের অগ্রগতি রোধ করে, এত গণতন্ত্রের দরকার কী? বস্তুত, এই মত অনেকেই মনে মনে পোষণ করিয়া থাকেন, অনেক সময় মনের কথা ফাঁসও হইয়া যায়। বিবিধ প্রসঙ্গেই শোনা যায়: একেবারে তুলিয়া দেওয়া না হউক, অন্তত গণতন্ত্রের ‘বাড়াবাড়ি’ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ‘অনুদার গণতন্ত্র’-এর ধারণা সাধারণ বুদ্ধিতে সোনার পাথরবাটির সমান মনে হইতে পারে, কিন্তু এই ধারণা অনেক দিন যাবৎ বিদ্বৎসমাজে বহুচর্চিত, এবং দুনিয়ার বহু দেশেই নানা ধরনের অনুদার গণতন্ত্র শাসন করিতেছে। ভারতের বর্তমান প্রবণতাও তাহার অভিমুখী। উদ্বেগ সঙ্গত বইকি। বিশেষ করিয়া দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলি, এমনকি বিরোধীরাও যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকেন, তখন সেই উদ্বেগ আরও এক পর্দা চড়িয়া যায়। ভারতীয় গণতন্ত্রের বহুদলধারিণী প্রতিমাটি কি ক্রমে বিসর্জনের পথে যাইবে?