পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত। নওয়াজ শরিফ, আশরফ গনি ও নরেন্দ্র মোদী। উফা, রাশিয়া। ছবি: পিটিআই।
একশো এগারো বছর আগে ব্রিটিশ ভূ-রাজনীতিবিদ হ্যালফোর্ড জন ম্যাকিনডার বলেছিলেন, ইউরেশিয়ার ‘হার্টল্যান্ড’ হল পৃথিবীর ভৌগোলিক কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বুঝিয়েছিলেন প্রধানত জার-শাসিত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলিকে, পরে যা সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯০৪ সালে রয়্যাল জিয়োগ্রাফিকাল সোসাইটির অধিবেশনে ম্যাকিনডার একটি পেপার পড়েন, যার বক্তব্য ছিল: এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দুনিয়া হাতের মুঠোয় ভরে ফেলা যায়। সেই পেপারটি নরেন্দ্র মোদী পড়েছেন, এমন দাবি কাউকে করতে শোনা যায়নি। তবে সম্প্রতি তিনি যে ভাবে রাশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া— ইউরেশিয়ার হৃদয়পুরে সপ্তাহাধিক কাল সফর করে ফিরলেন, তা দেশে ও বিদেশে অনেকেরই নজর কেড়েছে। মোদী-শরিফ আলাপ তার একমাত্র কারণ নয়। প্রধানমন্ত্রীর এ বারের সফরের তাৎপর্য অন্যত্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ভারত ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্ক তখন জোড়া লাগেনি। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার অভিঘাতে মধ্য এশিয়ায় রাতারাতি নতুন পাঁচটি দেশের জন্ম হলে সোভিয়েত-বন্ধু দিল্লি সেই সদ্যোজাত রাষ্ট্রগুলিকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিতে দেরি করেনি বটে, কিন্তু সোভিয়েত-উত্তর দুনিয়াতে মধ্য এশিয়ার খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ দেশগুলির গুরুত্ব অন্য মাত্রা অর্জন করতে চলেছে, তা বুঝতে ভারতের অনেক সময় লেগেছে। দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবেশ নীতির অভাবে দিল্লির এই বিহ্বলতা। চিন কিন্তু সেই ভুল করেনি।
ভারতের অর্থনীতির মোড় ঘুরেছিল যাঁর হাত ধরে, সেই নরসিংহ রাওই সোভিয়েত-পরবর্তী যুগে প্রথম মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে উদ্যোগী হন। তাঁর সময়ে দিল্লি শুধু ‘পুবে তাকাও নীতি’র সূচনা করেনি, ‘উত্তরে তাকাও নীতি’র কথাও বলেছিল। প্রায় দুই দশক পরে মোদী সেই বিস্মৃতপ্রায় নীতির অনুসারী।
জ্বালানি নিরাপত্তা
দ্রুত আয়বৃদ্ধির পথে অগ্রবর্তী ভারতে জ্বালানির চাহিদা বিপুল। মধ্য এশিয়ার দেশগুলি হাইড্রোকার্বন ও ইউরেনিয়ামের মতো খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ১০৭৮ মাইল দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন ভারতে এলে এখানকার জ্বালানির সংকট অনেকটা মোকাবিলা করা সম্ভব। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে ইসলামি জঙ্গি কার্যকলাপ সেই প্রকল্পের পথে প্রধান অন্তরায়। মূলত, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের আর্থিক আনুকূল্যে হবে পাইপলাইনটি। কিন্তু আফগানিস্তানের নয়া রাষ্ট্রপতি আশরফ গনি বলেছেন, ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে তা কার্যত অসম্ভব। কাজ শেষ হলে উক্ত তিনটি দেশ বছরে ৩২০ কোটি ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস পেতে পারে। সবচেয়ে গ্যাস-সমৃদ্ধ দেশগুলির অন্যতম তুর্কমেনিস্তানে আনুমানিক ১৬ লক্ষ কোটি ঘনফুট গ্যাস মজুত আছে।
অন্য দিকে, চিন ইতিমধ্যেই তুর্কমেনিস্তান থেকে উজবেকিস্তান ও কাজাকস্তান হয়ে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে যথেষ্ট এগিয়েছে। উত্তর আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তান হয়ে চিনের জিনজিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত শুধু নয়, দেশের পূর্ব অংশ পর্যন্ত বিকল্প পাইপলাইন তৈরির ভাবনাও ফলপ্রসূ হতে চলেছে। ২০২০-এর মধ্যে ৬৫০০ ঘনফুট গ্যাস চিনকে সরবরাহ করতে তুর্কমেনিস্তান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
জুন ২০১২’য় ভারতের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী ই আহমেদ ভারত-মধ্য এশিয়া সংলাপ-এর প্রথম বৈঠকে মূল ভাষণ দিতে গিয়ে নয়াদিল্লির ‘কানেক্ট সেন্ট্রাল এশিয়া পলিসি’র (সিসিএপি) কথা বলেন। কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশ্কেক-এ বৈঠকটি হয়েছিল। এই নীতির উদ্দেশ্য, মধ্য এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সঙ্গে দ্রুত ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় করা। পরের মাসে বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ তাঁর তাজিকিস্তান সফরের সময় বলেছিলেন যে, বাণিজ্য, যোগাযোগ, কূটনৈতিক এবং সামাজিক সংযোগই এই নীতিকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম।
তা সত্ত্বেও কাজাকস্তানের কাশাগান তৈলক্ষেত্রের কন্কো-ফিলিপস সংস্থার ৮.৪ শতাংশ শেয়ার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বেজিং দিল্লিকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। ওই সংস্থার ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের শেয়ার ভারতের ওএনজিসি বিদেশ লিমিডেট-কে বিক্রির কথা থাকলেও, ২০১৩’য় কাজাকস্তান সরকার বেঁকে বসে। মোদীর সফরে কাজাকস্তানের মত অনেকটা বদলেছে। রাজধানী আস্তানা-তে মোদী থাকাকালীন ভারত ও কাজাকস্তান কাস্পিয়ান সাগর অঞ্চলে যৌথ ভাবে তেল উত্তোলনের প্রাথমিক পদক্ষেপ করেছে। আগামী পাঁচ বছরে সে দেশ থেকে ইউরেনিয়াম আমদানির পরিমাণও দ্বিগুণ হওয়ার কথা। এর ফলে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া বাদে কাজাকস্তান হবে ভারতে বৃহত্তম ইউরেনিয়াম সরবরাহকারী দেশ। প্রসঙ্গত, আস্তানা ও নয়াদিল্লির মধ্যে এই বিষয়ে আগের সমঝোতার মেয়াদ গত বছরে শেষ হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জেও ভারত ও কাজাকস্তান পরস্পরের পাশে থেকেছে। কাজাকস্তান নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের সদস্যপদ প্রাপ্তিকে সমর্থন করেছে। মোদীও কথা দিয়েছেন যে, দিল্লি ২০১৭-১৮ সালে নিরাপত্তা পরিষদে কাজাকস্তানের অস্থায়ী সদস্য হওয়ার দাবিকে সমর্থন করবে।
সন্ত্রাসের প্রতিরোধে
মোদী কাজাকস্তানের নাজারবায়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা অস্থিরতার সীমান্তে দাঁড়িয়ে। চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রের কাছেই আমাদের অবস্থান।’ এই সমগ্র অঞ্চলের মুসলমান সমাজকে এ সংকট থেকে দূরে রাখাই এখানে লক্ষ্য। দিল্লি এই প্রেক্ষিতে ভারতের ইসলামি সমাজের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার ইসলামি দুনিয়ার সাযুজ্য খুঁজতে আগ্রহী। প্রথম পর্বে কিছুটা নিস্পৃহ থেকেও পরে সমস্যাসঙ্কুল আফগানিস্তানের আর্থিক বিকাশে ভারত অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু বোধহয় শেষরক্ষা হয়নি। আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তালিবান ছাড়াও ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর প্রভাব বেড়েছে। তাজিকিস্তানেও বেশ কিছু তরুণ আইএস-ঘনিষ্ঠ হয়েছে। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, তিউনিশিয়া বা কুয়েতে যে হারে আইএস প্রভাব বেড়েছে, তা ভারত ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলির পক্ষে খুব উদ্বেগজনক।
‘আরব বসন্ত’-পরবর্তী সময়ে উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় জাতিগত ও গোষ্ঠীগত সংঘাত বাড়ছে। এর ভূ-রাজনীতিগত ও ভূ-কৌশলগত তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতে প্রয়োজনের সত্তর শতাংশ পেট্রোপণ্য আমদানি হয়। পশ্চিম এশিয়ায় কর্মসূত্রে প্রায় সত্তর লক্ষ ভারতীয়ের বাস। তাঁদের স্বার্থরক্ষা যেমন দিল্লির দায়িত্ব, তেমনই খেয়াল করবার যে, এই প্রবাসী ভারতীয়দের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আসে। এই অর্থ ভারতীয় অর্থনীতির জন্য জরুরি। অন্য দিকে, ভারতে যত মুসলমানের বাস, ইন্দোনেশিয়া বাদে এত মুসলমান পৃথিবীতে আর কোথায়?
চিনের ছায়া
মধ্য এশিয়ার দেশগুলিকে রাশিয়া আজও নিজের পশ্চাদ্ভূমি মনে করলেও একুশ শতকের গোড়া থেকে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির নিরিখে এ অঞ্চলে আমেরিকার উপস্থিতি অনেকটা বেড়েছিল। কিন্তু এখানে ধারাবাহিক ভাবে চিনের প্রভাব বেড়ে চলেছে। কিরগিজস্তান, কাজাকস্তান ও তাজিকিস্তানের সঙ্গে চিনের সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের সীমানা রয়েছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলি গত শতকের নব্বইয়ের দশকে স্বাধীনতা পেলেও প্রথমে চিনের লক্ষ্য ছিল এই নতুন দেশগুলিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও ইসলামি উগ্রপন্থার প্রসার প্রতিরোধ। পরে নিজের জিনজিয়াং প্রদেশের আন্দোলন দমন ছাড়াও এই অঞ্চলে মজুত সম্পদের ভিত্তিতে জ্বালানির চাহিদা মেটানো চিনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ও ব্যবসাবাণিজ্য বাড়াতে চিন, রাশিয়া, কাজাকস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান যৌথ ভাবে সাংহাই ফাইভ গড়ে তোলে। ২০০১-এ উজবেকিস্তান এতে যোগ দেয় ও সংস্থাটির নাম বদলে হয় সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন। মোদীর এ বারের সফরে ভারত অবশেষে এই প্রভাবশালী আঞ্চলিক সংস্থাটির সদস্য হতে পারলেও, পাল্টা চাপ রাখতে চিন একই সঙ্গে পাকিস্তানকে এই সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ দিকে অবশিষ্ট ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা অবনতির জেরে রাশিয়া এখন মধ্য এশিয়ায় ভারতকে পাশে পেতে আগ্রহী। সেই সমর্থনের ফলে এবং মোদীর এ বারের মধ্য এশিয়া সফরের নিরিখে নয়াদিল্লি এই অঞ্চলের প্রাচীন ‘রেশম পথ’(সিল্ক রুট)-কে ফের মসৃণ করতে চায়। সাম্প্রতিক চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর নির্মাণ ভারতের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। এই নিরিখেই মোদী মধ্য এশীয় প্রতিবেশীদের কাছে সাচ্ছল্যমুখী সহযোগিতার স্বপ্ন ফেরি করেছেন। কিন্তু চিনের তুলনায় ভারতের আর্থিক সামর্থ্য সীমিত। চিন আর রাশিয়ার ঝুড়িতে নিজেদের স্বপ্নের সব ডিম না রেখে ভারতের ভিন্ন বিকল্প এই দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ বটে, তবে আর্থিক লেনদেনের পাশাপাশি তুলনায় পরমতসহিষ্ণু ভারতের ভাবমূর্তি সাংস্কৃতিক কূটনীতির মাধ্যমে তুলে ধরতে পারলে নয়াদিল্লির লাভের সম্ভাবনা সম্ভবত বেশি।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক