প্রতীকী ছবি।
বেশ কয়েকটি হাসপাতালের দরজায় দরজায় ঘুরিয়া মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন কোভিড-১৯’ আক্রান্ত এক তরুণ— এমনই শোনা গেল। বাস্তবিক, এই ধরনের ঘটনা বারংবার কানে আসিেতছে। বিস্তর হয়রানির পর বিনা চিকিৎসায় করোনা-আক্রান্তরা মারা যাইতেছেন, ইহা এখন ধারাবাহিক সংবাদ। এক প্রবীণের ঠাঁই মিলিয়াছিল হাসপাতালে। বাড়ির লোক যত বার ফোন করিয়া রোগীর অবস্থার খোঁজ করিয়াছিলেন, প্রতি বারই জবাব মিলিয়াছিল, অবস্থা স্থিতিশীল। শেষ অবধি জানা গেল, ভর্তি হওয়ার দিনই মারা গিয়াছেন তিনি, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাড়ির লোককে কথাটি জানাইয়া উঠিতে পারে নাই। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই ঘটনাটিও ব্যতিক্রমী নহে— একই অভিযোগ পূর্বেও শোনা গিয়াছে। রোগীর মৃত্যু ঘটিলে পরিবারের অনিশ্চয়তা কোন মাত্রায় পৌঁছাইতেছে, তাহার প্রমাণ বহন করিতেছে স্বরাষ্ট্রসচিবের একটি নির্দেশ— তিনি জানাইয়াছেন, প্রয়াত ব্যক্তির শেষকৃত্য কখন সমাপ্ত হইল, পরিবারকে সেই কথা জানাইবার ব্যবস্থা করিতে হইবে, প্রয়োজনে বিশেষ টেলিফোন লাইন খুলিতে হইবে। নির্দেশটি আসিবার পূর্বে বঙ্গে কোভিডে মৃতের সংখ্যা এবং কো-মর্বিডিটির শিকার সংখ্যা কম নহে। তাঁহাদের অনেকেরই পরিবার ঠিক ভাবে জানিতে পারে নাই যে তাঁহাদের প্রিয় জনের অন্তিম সংস্কার কখন শেষ হইল। মর্মান্তিক বলিলে কম বলা হয়।
সংবাদগুলি হইতে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার, বিশেষত অতিমারি-কেন্দ্রিক পরিকাঠামোর যে ছবি প্রস্ফুটিত হয়, তাহা ভয়ঙ্কর। সরকারি নির্দেশগুলি সরকারি ও বেসরকারি, উভয় গোত্রের হাসপাতালেই দৃশ্যত উপেক্ষিত হইতেছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ অমান্য করিয়া বেসরকারি হাসপাতালগুলি কোভিড রোগী ভর্তি করিতে বিপুল অর্থ দাবি করিতেছে। সরকারি হাসপাতাল রোগী প্রত্যাখ্যান করিতেছে। সকল হাসপাতালই রেফার করিবার নির্দিষ্ট নিয়ম না মানিয়া রোগী রেফার করিতেছে। অন্য দিকে, বিলম্বের পিছনে স্বাস্থ্য দফতরের ভূমিকাও স্পষ্ট। রক্ত পরীক্ষার ফল স্বাস্থ্য দফতর হইতে ঘুরিয়া তবেই প্রকাশ করা হইতেছে। রোগী ভর্তির সিদ্ধান্তও করিতেছে স্বাস্থ্য দফতরের কন্ট্রোল রুম। যদি সরকারি আধিকারিকের ছাড়পত্রের জন্য চিকিৎসা শুরু করিবার প্রতীক্ষা করিতেই হয় রোগীকে, তবে সেই ছাড়পত্র দ্রুত আসা প্রয়োজন। কোভিড রোগীদের জন্য কয়েকটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করিয়া দিবার সিদ্ধান্তও বিলম্বের অন্যতম কারণ। যে সকল সমস্যার চিকিৎসা হইতে পারিত স্থানীয় হাসপাতালে, কোভিড সন্দেহ হইলে সেই রোগীকেই রেফার করা হইতেছে দূরের প্রতিষ্ঠানে।
সম্পূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে যে বস্তুটির অভাব প্রকট, তাহার নাম সহমর্মিতা। তাহার একটি অংশ প্রাতিষ্ঠানিক, অন্য অংশটি ব্যক্তি-সাপেক্ষ। রোগীর পরিজনদের প্রধানতম অভিযোগ, কেহ তাঁহাদের রোগী সম্বন্ধে তথ্য দেন না, কেহ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন না। অভিযোগটি শুধু কোভিড-কালের নহে। ঘটনা হইল, সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ এত বিপুল যে ডাক্তার বা নার্সদের পক্ষে প্রতি রোগীর পরিবারকে এই সময় দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু, প্রত্যেক হাসপাতালে একটি বিভাগ গঠন করা সম্ভব, যেখানে যোগাযোগ করিলেই পরিজনরা রোগী সম্বন্ধে তথ্য পাইবেন, প্রয়োজনে তাঁহাদের কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থাও হইবে সেই বিভাগে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রত্যেক রোগী সম্বন্ধে প্রতিটি তথ্য ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আপলোড করিয়া দেওয়া সম্ভব। তথ্যের অভাবে হয়রানির অবকাশই থাকিতে পারে না। তবুও থাকে, তাহার মূল কারণ প্রাতিষ্ঠানিক সহমর্মিতার অভাব। কোভিড-ও হয়তো এক সময় নির্মূল হইবে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের এই রোগ সারিবে কি?