—প্রতীকী ছবি
সোমবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বয়স একশো পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্ণ হইল। প্রাচীনতা যদি গৌরবের উৎস হয়, তবে কংগ্রেসের নেতা কর্মী ও সমর্থকরা অবশ্যই গৌরবান্বিত বোধ করিতে পারেন। কিন্তু আপন রাজনৈতিক সাফল্য এবং গণতান্ত্রিক সামর্থ্যের হিসাব কষিয়া এই প্রাচীন দলটির অন্তঃস্থল হইতে প্রতিষ্ঠা দিবসের শীতার্ত প্রভাতে যে একটি প্রগাঢ় দীর্ঘশ্বাস উঠিয়া আসিয়াছে, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। ‘অন্তর্বর্তী’ সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন, তাহা বড় কথা নহে— শারীরিক কারণে অনুপস্থিতি ঘটিতেই পারে। কিন্তু সভানেত্রী যে প্রায় দেড় বৎসর ধরিয়া অন্তর্বর্তী, তাহাই করুণ বাস্তবকে বুঝাইয়া দেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রকট হইয়া উঠে এই দিনটিতে রাহুল গাঁধীর দেশের বাহিরে থাকা। তাঁহার বিদেশ সফরকে ‘ব্যক্তিগত’ বলিয়া আলোচনার বাহিরে রাখিলে তাহা হইবে ভাবের ঘরে বড় রকমের ডাকাতির শামিল। রাজনৈতিক জীবনের শুরু হইতে আজ অবধি তাঁহার আচরণে এক বিচিত্র অস্থিরতার প্রদর্শনী চলিয়া আসিতেছে। গত লোকসভা নির্বাচনের উদ্যোগপর্বে সেই দোলাচল কাটিবার লক্ষণ দেখা দিয়াছিল, কিন্তু জনতার রায়ে দলের ভরাডুবির পরে সভাপতির আসন হইতে তাঁহার পদত্যাগে এবং পরবর্তী আচরণে পুরানো ধারাই নূতন করিয়া প্রকট। ইদানীং শোনা যাইতেছে, তিনি নাকি ২০২২ সালের শেষের দিকে দলের হাল ধরিবেন। তত দিন অবধি হালটি আদৌ থাকিবে কি না, তাহা অবশ্য কাহারও জানা নাই।
অথচ দেশের রাজনীতিতে কংগ্রেস নামক দলটির প্রয়োজন ফুরায় নাই। বস্তুত, প্রয়োজন বাড়িয়াছে। অসহিষ্ণু সংখ্যাগুরুতন্ত্রের আধিপত্যবাদী অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন পরিসরে ও বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ প্রতিরোধ চলিতেছে। ২০২০ সালটি সেই মাপকাঠিতে বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বছরের শুরুতে নাগরিকত্ব লইয়া সর্বনাশা রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন যে উত্তাপ সৃষ্টি করিয়াছিল, শাহিনবাগ যাহার ভরকেন্দ্র এবং প্রতীক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, বৎসরের শেষে কৃষক আন্দোলনের তেজ যদি তাহার কথা বারংবার মনে পড়াইয়া দেয়, তবে তাহা কেবল স্মৃতিচারণার ব্যাপার নহে, দুই আন্দোলনই একটি বিন্দুতে মিলিয়া গিয়াছে, তাহার নাম শাসকের স্বৈরতান্ত্রিক দাপটের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা, যাহা গণতন্ত্রের মূল ধর্ম। এই প্রতিবাদ আকস্মিক নহে, অযৌক্তিকও নহে। অতিমারির বিপৎকালে কেন্দ্রীয় সরকার তথা শাসক দলের অ-গণতান্ত্রিকতা ক্রমাগত নিরাবরণ হইয়াছে, সেই অনুপাতে তাহার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়িয়াছে।
কিন্তু দলীয় রাজনীতির পরিসরে এই সমস্ত বিক্ষোভের প্রতিফলন এখনও ক্ষীণ। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল বিক্ষিপ্ত ভাবে প্রতিবাদী ও প্রতিস্পর্ধী ভূমিকা পালনের চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু তাহাকে একটি যথার্থ বিরোধী রাজনীতির পরিসরে সমন্বিত ও সংগঠিত করিবার গণতান্ত্রিক প্রকল্পটি এখনও শুরুই হয় নাই। এই সমন্বয় ও সংগঠনের কাজে কংগ্রেসের মতো একটি দল কার্যকর ভূমিকা লইতে পারিত। বহু দুর্বলতা, বহু স্ববিরোধ, অতীতের বহু ত্রুটি ও অপরাধ সত্ত্বেও তাহার ইতিহাসে এবং চরিত্রে এক ধরনের স্বাভাবিক উদার গণতান্ত্রিকতার উত্তরাধিকার আছে, যাহা সঙ্ঘ পরিবারের সর্বগ্রাসী অসহিষ্ণুতার বিপ্রতীপ, যাহা বিভিন্ন মত, বিভিন্ন বর্গ, বিভিন্ন স্বার্থকে অনেক দূর অবধি সঙ্গে লইয়া চলিতে পারে। এখানেই তাহার রাজনৈতিক সম্ভাবনা। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে কার্যকর রাজনীতিতে পরিণত করিবার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব। সেই প্রয়োজন মিটাইতেই কংগ্রেস অপারগ। দল গৌণ, সেই দলের বয়স একশো পঁয়ত্রিশ বৎসর হইলেও। কিন্তু কংগ্রেসের এই শোচনীয় ব্যর্থতা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক।