ভারতে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের ইতিহাস যত দিনের, তাঁহার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ইতিহাসও কার্যত তত দিনেরই। সাহিত্যিক হইতে বিজ্ঞানী, অভিনেতা হইতে মানবাধিকার কর্মী, গণপরিসরের প্রায় প্রতিটি কোণ হইতেই প্রতিবাদ ধ্বনিত হইয়াছে। অনেকেই মনে করাইয়া দিয়াছেন, ভারত যে অসহিষ্ণু একদেশদর্শিতার পথে হাঁটিতেছে, তাহা মারাত্মক। সম্প্রতি ৬৫ জন ভূতপূর্ব আমলা যে খোলা চিঠি প্রকাশ করিলেন, তাহাকে কি এই প্রতিবাদেরই আর একটি প্রকাশ হিসাবে দেখা যায়? না কি, ইহার ভিন্নতর কোনও গুরুত্ব আছে? আমলারা তাঁহাদের পেশাধর্ম মানিয়া নেপথ্যচারী। অবসরপ্রাপ্ত আমলাদেরও সচরাচর প্রকাশ্যে, কোনও রাজনৈতিক প্রশ্নে, মতপ্রকাশ করিতে দেখা যায় না। তাঁহারাই যখন খোলা চিঠিতে ‘করবস্থান বনাম শ্মশান’-এর তুলনা, আখলাক-হত্যাকাণ্ড বা গোরক্ষাবাহিনীর তাণ্ডবের ন্যায় প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, যখন ভিন্নস্বরকে দেশদ্রোহের নজির হিসাবে দাগাইয়া দেওয়ার বিপদের কথা মনে করাইয়া দেন, তখন বুঝিতে হয়, এই উদ্বেগের একটি ভিন্নতর মাত্রা রহিয়াছে। দেশ জুড়িয়া অসহিষ্ণুতার বাড়বাড়ন্তেই শুধু নহে, তাঁহারা সম্ভবত নিজেদের পেশাগত উত্তরাধিকার বিষয়েও চিন্তিত। কারণ, একনায়ককেও আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর করিতে হয়। অনুমান করা চলে, গত তিন বৎসরে ভারত যে পথে চলিয়াছে, তাহাতে আমলাদের সহযোগিতার অনিবার্যতাই প্রাক্তন আমলাদের উদ্বিগ্ন করিয়াছে। সত্যই তাহা হইলে এই উদ্বেগ মহৎ। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় আমলাদের ভূমিকা অপরিসীম। রাজনীতির বিষবাষ্পে সে প্রতিষ্ঠানের কাঠামোয় ক্ষয় হইলে সে ক্ষতি পূরণ করা অসম্ভব।
ইহা অনস্বীকার্য যে আমলারা শেষ সিদ্ধান্তের মালিক নহেন। সেই অধিকার মন্ত্রীর। কিন্তু, ভিন্নমত হইবার অধিকার আমলাদের বিলক্ষণ আছে। আইনের গণ্ডিই যে চূড়ান্ত নহে, সভ্য সমাজ যে ন্যায়কে নীতির ঊর্ধ্বে স্থান দেয়, এই কথাটি মন্ত্রীদের স্মরণ করাইয়া দেওয়া আমলাদেরই কর্তব্য। দুইটি উদাহরণ বিচার করিয়া দেখা যাইতে পারে। গো-হত্যা বিষয়ে ভারতীয় সংবিধানে কিছু ধোয়াশা রহিয়াছে। গোমাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সরকারি জেহাদটি সেই অস্পষ্টতারই সুযোগ লইতেছে। এই ক্ষেত্রে আমলারা স্মরণ করাইয়া দিতে পারেন, নাগরিকদের খাদ্যচয়নের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ নহে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি তবুও নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, তবে তাঁহাদের সহিত অসহযোগিতা করাই ধর্ম। ন্যায়ধর্ম। অথবা, বিভিন্ন অ-সরকারি সংস্থার টাকার জোগান বন্ধ করিয়া তাহাদের ভাতে মারিবার যে অপচেষ্টা কেন্দ্রীয় সরকার করিয়াছে, সে ক্ষেত্রেও আমলাদের কর্তব্য ছিল মন্ত্রীদের স্মরণ করাইয়া দেওয়া যে আইনের ফাঁক খুঁজিয়া প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার মধ্যে যে হীনতা আছে, তাহা গণতন্ত্রের সহিত মানানসই নহে। আমলাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করিবার অধিকার এবং ক্ষমতা মন্ত্রীদের আছে। কিন্তু, ক্রমাগত ভিন্নমতের সম্মুখীন হওয়ার যে চাপ, মন্ত্রীদের সিদ্ধান্তেও তাহার প্রভাব প়ড়িবে বলিয়া আশা করা চলে। মসৃণ ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করাই আমলাদের কাজ। কিন্তু, গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রয়োজনে বিদ্রোহীও হইতে হয়। প্রাক্তনরা কি বর্তমানকে সেই কথাই স্মরণ করাইয়া দিলেন না?