তারা পরিযায়ী, তবু এখন যেন সেই গ্রামেরই বাসিন্দা

আঙিনার বাসিন্দারা একদিন দেখলেন, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে শয়ে শয়ে শামুকখোল। স্বপ্ন দেখলেন, এ বার পাখি পর্যটনের হাত ধরে গ্রামের লক্ষ্মীলাভ হবে। তার পর? লিখছেন কৌশিকরঞ্জন খাঁসে ভাবে কোনও বনাঞ্চল নয়, আশেপাশে কোনও বড় দিঘির ভরসাতেও যে সেই পরিযায়ীরা এসেছে, তা-ও নয়। তা হলে বেছে বেছে দক্ষিণ দিনাজপুরের অখ্যাত গ্রামটিকেই কেন বাছল পাখিরা, সেটাই বিস্ময়ের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৫:৪০
Share:

পরিযায়ী পাখির দল।

পাখিও কি মানুষের সাহচর্য ভালোবাসে? কিছু পাখি আছে যেগুলো মানুষের আশেপাশে, বাড়ির আনাচেকানাচে থাকতে ভালোবাসে। যেমন দোয়েল, শালিক, টুনটুনি, ময়না, বুলবুলি। চড়ুই আর পায়রা তো মানুষের গা ঘেঁষে বসবাস করে। গ্রামবাংলায় প্রচুর বাড়ির আনাচকানাচ চড়ুইদের মেসবাড়ি হয়ে ওঠে। নিস্তব্ধ দুপুরে ভেন্টিলেটার থেকে ভেসে আসে সেই মেসবাড়ির কিচিরমিচির। ঝাঁক বেঁধে পায়রা এখনও শহর-মফসসলের বহু বাড়িতেই দেখা যায়।

Advertisement

কিন্তু একটা গ্রাম পাখির দখলে চলে যায়, এ দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় কি কখনও? এমনটাই ঘটছে বছর দশ পনেরো ধরে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জ ব্লকের সমজিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের আঙিনা গ্রামে। একটা প্রত্যন্ত গ্রাম, অথচ হঠাৎ করে ভালবেসে ফেলল একশ্রেণির পরিযায়ী পাখি, যাদের নাম শামুকখোল।

সে ভাবে কোনও বনাঞ্চল নয়, আশেপাশে কোনও বড় দিঘির ভরসাতেও যে সেই পরিযায়ীরা এসেছে, তা-ও নয়। তা হলে বেছে বেছে দক্ষিণ দিনাজপুরের অখ্যাত গ্রামটিকেই কেন বাছল পাখিরা, সেটাই বিস্ময়ের। আর পাঁচটা প্রত্যন্ত গ্রামের মতোই ধান জমির পাশে মাটির ঘরবাড়ি নিয়ে সবুজে মোড়া গ্রামটি। চোখে পড়ার মতো বড় বড় আম, জাম, কাঁঠালের গাছ আছে এখানে। উঁচু উঁচু ঝাঁকড়া গাছের ছায়ায় গ্রামের সাদামাঠা ঘরগেরস্থি। আর এই সব গাছের মাথাতেই বাসা বেঁধেছে পরিযায়ী পাখি শামুকখোল।

Advertisement

প্রতি বছর বর্ষার মুখে এই পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে আঙিনা গ্রামের মস্ত বড়ো বড়ো গাছে ঘর বাঁধে। তাদের সন্তানসন্ততি হয়। ওই বড়ো গাছগুলোই তাদের ঠিকানা হয়ে ওঠে। বর্ষা শেষে শীতের শুরুতে তারা আবার ডানা মেলে উড়ে যায় অন্য কোনওখানে। তবে গ্রাম কখনওই পাখিশূন্য হয় না। কিছু পাখি উড়ে যেতে ভুলে যায়, কিংবা হয়তো বাঁধা পড়ে যায় আঙিনা গ্রামের টানে।

প্রথম যখন এই পাখিরা অর্থাৎ এশিয়ান ওপেন বিল, নাইট হেরন, ব্ল্যাক আইবিচ, গ্লসি আইবিচ আসতে শুরু করেছিল সেই দেড় দশক আগে, তখন গ্রামবাসীদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। পাখিগুলোকে বাড়ির অতিথি মনে করেছিল তারা। উঠোনের গাছে ভিন দেশি পাখি আসছে--- এটা তাদের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। তার পর সে খবর যখন মুখে মুখে রটে গেল, প্রচুর মানুষ, খবরের কাগজের লোক আসা শুরু করল, তখন তাদের কাছে পাখির বসতির দিনগুলো হয়ে উঠল উৎসবের দিন। খবরের কাগজ, নিউজ চ্যানেলের লোক বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালে আঙিনা গ্রামের প্রতিটি লোক 'সেলিব্রিটি' হয়ে ওঠার স্বাদ পেয়েছিল। তারা বুঝেছিল, এত আয়োজন, এত উৎসাহী পর্যটক সবই ওই পরিযায়ী পাখিদের সৌজন্যে। তাই প্রতিটি বাড়ির সদস্য হয়ে উঠেছিল শামুকখোল পাখিগুলো।

তাদের নিয়ে খুবই আন্তরিক ছিল আঙিনা গ্রামের মানুষেরা। নিজের উঠোনের গাছে বাসা বাঁধা পাখিগুলোকেও তারা পরিবারের সদস্য বই অন্য কিছু ভাবত না। ঝড়–বৃষ্টির দিনে মানুষগুলোর দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। বাইরে তুমুল হাওয়া চলছে, এদিকে তারা ঘরবন্দি হয়ে ভাবত, পাখিগুলোর কী হবে! ঝড় থামলে বাড়ির বুড়োকর্তা দোর খুলে আকাশের দিকে তাকাতেন।গাছের মগডালে পাখিদের গৃহস্থলী কেমন আছে!পাখির বাচ্চা কোনওভাবে পড়ে গেলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তাকে মগডালের বাসায় রেখে এসেছে। উঠোনে ডিম পড়ে ফেটে থাকলে তারাই প্রিয় হারানোর কষ্ট পেয়েছে।

এই পাখিগুলোর দৌলতে বাইরের মানুষ গ্রামে আসা শুরু করলে দুচারটে অস্থায়ী দোকান হল। তেলেভাজা, চা সিগারেট, ডিমের ওমলেট বিক্রি করে গরিব মানুষগুলো কিছু পয়সারও মুখ দেখল। এই পাখিদের ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসাটা তাদের কাছে আশীর্বাদ মনে হয়েছিল। গ্রামের ছেলেদের উদ্যোগে গঠিত হলো 'আঙিনা বার্ড এ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন সোসাইটি'। পর্যটক টানতে জেলা জুড়ে পোস্টার পড়লো — 'হাজার পাখির গ্রাম, আঙিনা তার নাম'।

জেলার মানুষ পরিযায়ী পাখিগুলো দেখতে প্রথম প্রথম ভিড় করল। সরকারি কর্তাব্যক্তিদের সাদা গাড়ি আর বুটের মচমচ আওয়াজে গ্রাম ভরে উঠল। অবহেলিত আঙিনায় তখন আশার আলো গ্রামটি আশা--- এবার পাকা রাস্তা হবে, অতিথিশালা হবে, পাখি দেখতে 'ওয়াচ টাওয়ার' হবে। কিছু না কিছু কর্মসংস্থান, আয়ের নতুন উপায় হবে। পাখিগুলোর খাবারের যথাযথ বন্দোবস্ত হবে। কেননা খাবারের জোগান না থাকলে শামুকখোলেরা একদিন না একদিন আঙিনা গ্রামে আসার উৎসাহ হারাবেই। তাই আশা করা গিয়েছিল গ্রাম সংলগ্ন পুকুরগুলো সংস্কার করে ছোট মাছ ছাড়া হবে।

কত কিছুই তো ভেবেছিলেন আঙিনার মানুষ! কিন্তু এই ঘোর কাটতে বেশি দিন সময় লাগল না। পাখির আগমন নিয়ে উৎসাহ ক্রমে ফিকে হল। কমল পর্যটক। উল্টে গ্রাম জুড়ে পাখির বিষ্ঠা। তখন ভয় হল তাদের, এই পচা বিষ্ঠা থেকে গ্রামে রোগভোগ না ছড়ায়! স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে গ্রাম পরিষ্কার করার কাজ করেছিল। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না।

এখনও ছোট্ট গ্রাম আঙিনার পাশ দিয়ে যেতে গেলে দেখা যায় গাছগুলোর ডালে ডালে পাখিদের বাসা। কোনও কেনওটি থেকে হলুদ ঠোঁট বের করে পক্ষীছানা খাবার চাইছে। গাছের উপরে বাসাগুলো ছাড়িয়ে ওই মেঘের কাছাকাছি বিমানের মতো চক্কর দিচ্ছে কিছু শামুকখোল। বহিরাগত দেখে অদ্ভুত শব্দে আলাপ করতে চাইবে।

যেন বলছে, ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement