প্রতীকী ছবি।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বিল নিয়ে তরজা এখন তুঙ্গে। অভিযোগ, অধিকার রক্ষার নামে এই বিল নাগরিকের মৌলিক অধিকার কাড়ার রাস্তা সুগম করতে চলেছে। একই সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ বা টুইটারের মতো সংস্থাকে (ইন্টারমিডিয়ারি) বলা হয়েছে সরকারের প্রয়োজনে যে কোনও কথোপকথন এবং সেই আলোচনায় যোগদানকারীদের সম্পর্কিত সব তথ্য সরবরাহ করতে হবে। টুইটার এর বিরোধিতা করে আদালতের দ্বারস্থ। সরকারের দাবি, দেশের সুরক্ষার স্বার্থেই তথ্য গোপন রাখার সুযোগ নিয়ে অপরাধমূলক আলোচনা ঠেকাতেই এই রাস্তায় হাঁটছে সরকার। বিচারাধীন এই মামলা নিয়ে আদালতের রায়ের অপেক্ষায় থেকে বরং দেখা নেওয়া যাক তথ্য সুরক্ষা বিল নিয়ে তরজার মূল সুরটা।
একটা মন্তব্যের উপর চোখ বুলিয়ে আমরা ফিরব প্রসঙ্গে। সুপ্রিম কোর্টের যে বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি এই বিলটি লোকসভায় পেশ হয় ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর, সেই বি এন শ্রীকৃষ্ণই সংবাদপত্রের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে এই জাতীয় সরকারি আদেশে স্পষ্ট করে রাষ্ট্র বিরোধিতা কাকে বলে তা না বলা থাকলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আর এই একই অভিযোগে বিদ্ধ হচ্ছে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বিলটি। এই বিলটি ২০২০ সালের বাজেট অধিবেশনের মধ্যেই পাস হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিলটি মীনাক্ষী লেখিকে শীর্ষে রেখে যে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয় তারাই এই বিলটি আরও খতিয়ে দেখার জন্য সময় চেয়ে নিয়েছে।
এই বিলটি পেশ করার সময় নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষাকেই উদ্দেশ্য হিসাবে তুলে ধরে বিশেষ নজরদারি সংস্থা তৈরির অধিকারও চাওয়া হয়। কিন্তু এই উদ্দেশ্য কতটা ঠিক, অর্থাৎ বিলের ৩৫ এবং ৩৬ ধারা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। এই ধারায় বলা হয়েছে যদি মনে করা হয় যে কোনও নাগরিক সম্পর্কিত তথ্য দেশের কোনও আইন বিরোধী, তা হলে আইনের স্বার্থ রক্ষায় বা অনুসন্ধানের প্রয়োজনে এই অধিকার সেই নাগরিক বা সংস্থার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না।
আর প্রশ্ন উঠেছে এখান থেকেই। লেখি কমিটিও এই বিলটি আইনে পরিণত হলে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের উপর সরকারকে প্রশ্নাতীত অধিকার দিতে পারে কি না তা খতিয়ে দেখতেই সময় চেয়ে নেয়। সমালোচকদের দাবি, তথ্যের সুরক্ষা আইন জরুরি। কিন্তু তাদের প্রশ্ন এই বিলের ধারা ব্যবহার করে সরকার যাঁকে খুশি এই আইনের আওতায় নিয়ে এসে তাঁর ব্যক্তিগত তথ্যের উপর হস্তক্ষেপ করবে না তো?
দেশের সুরক্ষা ভঙ্গ হওয়া বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তা এই বিলে উল্লেখ না থাকাতেও উঠেছে প্রশ্ন। পুলিশ বা আইন রক্ষার যে কোনও সংস্থা যদি কাউকে অভিযুক্ত করে, তা হলে অভিযুক্তের এই আইনের সুরক্ষা বলয় ব্যবহার করার অধিকারই থাকবে না। আর তাই যদি হয় তা হলে একে তথ্য সুরক্ষা আইন বলা যাবে কি?
শ্রীকৃষ্ণ কমিটি কিন্তু তাঁদের রিপোর্টে খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে বিলটি তৈরির সময় এই অধিকার কোথায় বলবৎ থাকবে না তা যেন স্পষ্ট করে লেখা থাকে। শুধু রাষ্ট্রের স্বার্থের উল্লেখ যথেষ্ট নয়। সেই স্বার্থকে ব্যাখ্যা করারও প্রয়োজন আছে। অন্যথায় রাষ্ট্রের স্বার্থ ব্যাহত হয়েছে এই অজুহাতে আইনের অপব্যবহার হতে পারে।
হোয়াটস্অ্যাপ বা টুইটারের মতো সংস্থার ক্ষেত্রে যে বিধি কেন্দ্র চালু করতে চাইছে সেই বিধি নিয়েও একই মন্তব্য করেছে এই কমিটি। সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা মানেই তা রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। অক্সিজেনের সরবরাহ নিয়ে সরকারের সমালোচনা করা কিছুতেই রাষ্ট্রদ্রোহ বা অপরাধমূলক কাজ বলে গ্রাহ্য হওয়া উচিত নয়, মত তাঁদের।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে যে ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ বিরোধী আইন বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রেক্ষিতে, এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে সংশয় ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে। শিল্পমহলও চিন্তিত। কারণ, তাঁদের ধারণা এই আইন চালু হলে ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তাও হ্রাস পেতে পারে। এই আইনে যে ভাবে ব্যক্তিগত তথ্যকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তার পরিধির বাইরে থাকছে পেটেন্ট বা মেধা সম্পদ অথবা ব্যবসা সম্পর্কিত গোপন তথ্য যা ফাঁস হলে ব্যবসার ক্ষতি হতে পারে।
এমনিতেই ভারতের আইনের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সংশয় রয়েছে। সংশয় রয়েছে সাধারণ পরিস্থিতিতেই মেধা সম্পদ রক্ষায় ভারতীয় আইন ব্যবস্থার নানান ফাঁকফোকড় নিয়ে। তার উপরে এই তথ্য সুরক্ষা আইন, যেখানে অপরাধের বর্ণনা অস্পষ্ট বলে দাবি, তার প্রয়োগ বিধি ব্যবসার ক্ষেত্রে আরও বেশি অন্তরায় হয়ে উঠবে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল।
তার থেকেও বড় চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রবিরোধিতার স্পষ্ট ব্যাখ্যার অভাব। সাম্প্রতিককালে এই অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার হার যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনই কমেছে আদালতে গিয়ে সেই অভিযোগ টেকার হার। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ধারা আইপিসি-র ১২৪-এ ধারায়, যা দেশদ্রোহীতা বিরোধী আইন বলে পরিচিত। অভিযুক্তের সংখ্যা বেড়েছে ১৬০ শতাংশ। কিন্তু আদালতে অভিযোগ টিকেছে অভিযুক্তের ৩.৩ শতাংশ ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালে এই অনুপাত ছিল ৩৩.৩ শতাংশ। তাই এই আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগের যে একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে তা ভাবার কিন্তু একটা জায়গা তৈরি হয়েই গিয়েছে।
এই জাতীয় আইন, যেখানে তদন্তকারী সংস্থাকে প্রায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার অধিকার দেওয়া হয়েছে অভিযুক্তের প্রায় সব অধিকার রদ করেই, সেই আইন কি সত্যিই আমাদের অধিকার সুরক্ষিত রাখবে এবং কী ভাবে? এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু জরুরি।