প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকে কোনও চমক ছিল না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শক্তি সংক্রান্ত সহযোগিতা, চেন্নাই ও ভ্লাডিভস্টকের মধ্যে পরিবহণ যোগাযোগের উন্নতি এবং অস্ত্র উৎপাদন সংক্রান্ত সমস্যা মিটাইবার ব্যাপারে দুই পক্ষ সহমত হইয়াছে। অর্থাৎ পূর্বে যাহা চলিতেছিল, সেই প্রক্রিয়াকেই আরও আগাইয়া লইবার অঙ্গীকার, সঙ্গে বাণিজ্যিক বন্ধনটি আরও মজবুত করা। তবু গত ছয় বৎসরে মোদী ও পুতিনের এই বিংশতিতম বৈঠক গভীর ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সেই তাৎপর্য প্রতীকে। জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করিবার পর আন্তর্জাতিক মহলে বৃহৎ শক্তিগুলির সহায়তা লাভ করা এখন ভারতের পক্ষে বিশেষ রূপে জরুরি। ইতিমধ্যেই কাশ্মীর প্রশ্নে কড়া প্রতিক্রিয়া জানাইয়াছে চিন, এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষেই থাকিবার কথা বলিয়াছে। পশ্চিমের একাধিক দেশ ইহাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলিয়া চিহ্নিত করিলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নীরব থাকে নাই। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, সামান্য সতর্কীকরণ বাদ রাখিলে, ভারতকে প্রায় পূর্ণ সমর্থন দিয়াছে রাশিয়া। এমনকি, কোনও দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অনধিকার’ লইয়া সহমত হইয়াছেন মোদী ও তাঁহার ‘ভাল বন্ধু’ পুতিন। যৌথ বিবৃতিও প্রকাশিত হইয়াছে। কারণটি সহজ— একই দোষে দুষ্ট রাশিয়াও। ২০১৪ সালে সেনা নামাইয়া যে কায়দায় ক্রাইমিয়া হস্তগত করিয়াছিলেন পুতিন, যে কোনও অনাচারের উপমাস্বরূপ উহা ব্যবহার করা চলে। ক্রাইমিয়া লইয়া ইউক্রেনের সহিত বিবাদও চলমান।
প্রতীক সৃষ্টির অপর তাৎপর্যটি নিঃসন্দেহে বিশ্ব রাজনীতির অস্থির পরিবেশে দুই বৃহৎ শক্তির অবস্থান বদল। গত দুই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত যত ঘনিষ্ঠ হইয়াছে নয়াদিল্লি, তত মস্কো হইতে দূরে সরিয়াছে। বিপরীতে, দিল্লির শিরঃপীড়া বাড়াইয়া মস্কোও কৌশলগত ভাবে চিনের সহিত ঘনিষ্ঠতা বাড়াইয়াছে। পাকিস্তানি সেনার— তৎসূত্রে তালিবানদের সহিত তাহারা কিঞ্চিৎ গা ঘষাঘষিও করে নাই বলিলেও মিথ্যাচার হইবে। শল্যপর্বের শেষে এখন পারস্পরিক বিশ্বাস অর্জনের পালা। এক দিকে মার্কিন চাপ সত্ত্বেও রাশিয়া হইতে অস্ত্র ক্রয় স্থগিত রাখে নাই ভারত, এবং অন্য দিকে বেজিংয়ের সহিত মিত্রতা সত্ত্বেও নয়াদিল্লির স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে যত্নবান হইবেন বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছেন পুতিন। ইহা বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত, বিশ্ব রাজনীতি অনিশ্চয়তার নূতন পর্যায়ে প্রবেশ করিবার ফলে প্রত্যেকেই সম্ভাব্য বিকল্পগুলি বাজাইয়া দেখিতেছে। এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী হইলে কী রূপ লাভ, সেই বিষয়ে দুই পক্ষই অবগত।
রাশিয়া-ভারত সুসম্পর্কের ইতিহাসটি পুরাতন, সোভিয়েটের সহিত ইন্দিরা গাঁধীর নৈকট্য সুবিদিত ছিল। সেই আধারে নূতন সুধারস ঢালিলে যদি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকিতে পারে, তাহা হইলে পরিবর্তনই শ্রেয়।
আগামী দিনে রাশিয়া-চিন এবং ভারত-আমেরিকা সান্নিধ্য ছাপাইয়া নয়াদিল্লি ও মস্কোর বন্ধন দৃঢ়তর হইলে আশ্চর্য হইবার কারণ নাই।
দুই দেশের বাণিজ্যিক যে সূত্রটি ইতিপূর্বে শক্তিশালী ছিল না, ভ্লাডিভস্টকের বৈঠকে তাহাও প্রস্তুত হইয়াছে। অতএব, সঙ্কটমোচনের পরে এই বার কার্য সম্পাদনের পালায় মনোনিবেশ করিতে হইবে।