Grigori Perelman

গ্রিগরি পেরেলম্যান: সিংহাসন ছেড়ে বনবাসে

জ্যামিতিতে তাঁর অবদানের জন্য গ্রিগরি পেরেলম্যানকে ২০০৬ সালের অগস্ট মাসে গণিতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ফিল্ড মেডেল’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথামেটিক্স। লিখছেন অয়ন মুখোপাধ্যায়২০০০ সালের শুরুর দিক। ‘ক্লে ম্যাথামেটিকস ইনস্টিটিউড’ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ গণিতের সমস্যা সমাধানের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় পৃথিবীবাসীর উদ্দেশ্যে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৩২
Share:

গণিত-চর্চা। গ্রিগরি পেরেলম্যান (ইনসেটে)। ছবি: সংগৃহীত

অর্থ, যশ, ক্ষমতা লাভের মাপকাঠিতে বর্তমানে কোনও এক মানুষকে সফল বা ব্যর্থ বলে দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু এ সবের মধ্যেও এমন কিছু মানুষ আছেন যারা এক লহমায় অর্থ-যশ-প্রতিপত্তিকে ছুঁড়ে ফেলে মগ্ন হয়ে যান কাজে। তেমনই একজন গ্রিগরি পেরেলম্যান।

Advertisement

২০০০ সালের শুরুর দিক। ‘ক্লে ম্যাথামেটিকস ইনস্টিটিউড’ সাতটি গুরুত্বপূর্ণ গণিতের সমস্যা সমাধানের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় পৃথিবীবাসীর উদ্দেশ্যে। এত দিন যে সমস্যাগুলির সমাধান সঠিক ভাবে পাওয়া যায়নি, কেউ যদি তার সমাধান করতে পারে তবে মিলবে এক মিলিয়ন ডলার টাকা পুরস্কার। এখনও পর্যন্ত এর মধ্যে কেবলমাত্র একটি সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়েছে। সেই দুরূহ সমস্যার নাম ‘পোঁকেয়ার কনজেকচার’। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন গ্রিগরি পেরেলম্যান।

ভদ্রলোকের পুরো নাম গ্রিগরি ইয়াকোলেভিচ পেরেলম্যান। ১৯৬৬ সালের ১৩ই জুন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের লেলিনগ্রাডে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ, রাশিয়া) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ইয়াকভ পেরেলম্যান ছিলেন ইলেকট্রিক ইঞ্জিয়ার। মা লুবভ লোভবানা, গণিতের শিক্ষিকা। ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরনের অঙ্কের চ্যালেঞ্জ, দাবা খেলা, গ্রিগরিকে গণিতের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। দশ বছর বয়সেই গ্রিগরির গণিতে পারদর্শিতা প্রকাশ পেতে থাকে। বাবা-মা তাঁর এই দক্ষতা দেখে লেলিনগ্রাড সেকেন্ডারি স্কুলে পড়ানোর সময়ই তাকে বিশেষ গণিত ও পদার্থবিদ্যার প্রোগামে ভর্তি করিয়ে দেন। ফলস্বরূপ ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে সোনা জেতেন। জুটে যায় সরাসরি লেলিনগ্রাড স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগও।

Advertisement

১৯৮৭ সালে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা শেষ করে প্রকাশ করেন বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র। পরে ভর্তি হন স্টেকলভ্‌ ম্যাথামেটিক্স ইনস্টিটিউট-এ। তাঁর আগে ওই প্রতিষ্ঠানে কোনও ইহুদি ছাত্রকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সেখানে আলোকসানড্রভ, ইউরি বুরাগো প্রমুখ প্রবাদপ্রতিম গণিতজ্ঞের সান্নিধ্যে পেরেলম্যানের গণিতশিক্ষা অন্য মাত্রা লাভ করে। সেই সময় ফরাসি-রাশিয়ান গণিতজ্ঞ মাইকেল গ্রোমোভে সংস্পর্শে আসেন পেরেলম্যান এবং ‘আইএইচএসস’-এ কিছু দিন কাজ করার সুযোগ পান। সেই সময়ে তিনি বুরাগো ও গ্রোমোভের সঙ্গে একটি গবেষণাপত্র লেখেন। লেলিনগ্রাড স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্কুল অব ম্যাথামেটিক্স্‌ অ্যান্ড মেকানিক্স’ বিভাগ থেকে পি.এইচ্‌.ডি করেন তিনি। পরে উচ্চতর গবেষণার জন্য ‘স্টেকলোভ ইনস্টিটিউড অফ ম্যাথামেটিক্স’-এ যোগ দেন। ১৯৯২ সালে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি এবং স্টনিব্রুক ইউনিভার্সিটিতে এক সেমেস্টারের জন্য যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (বার্কেলে) থেকে তিনি ‘মিলার রিসার্চ ফেলোশিপ’ পান।

‘রিকি কার্ভেচার’ ও ‘ম্যানিফোল্ড’ এর উপর গবেষণা শুরু করেন তিনি। বিশ্বের অনেক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণার সুযোগ আসে। কিন্তু কোনও কিছুতেই গ্রিগরি কাঙ্ক্ষিত চ্যালেঞ্জ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর ১৯৯৫ সালে হঠাৎ তিনি সব ছেড়ে দিয়ে রাশিয়ায় ফিরে যান। যোগ দেন সেন্ট পিটার্সবার্গের ‘স্টেকলব্‌ ইনস্টিটিউট’-এ।

ফরাসি গণিতজ্ঞ হেনরি পোঁকেয়ার এক দুরূহ গাণিতিক সমস্যা উপস্থাপন করেন। এটি ‘পোঁকেয়ার কনজেকচার’ নামে পরিচিত। ১৯৮২ সালে মাইকেল ফ্রিডম্যান চার মাত্রায় এটিকে প্রমাণ করেন। কিন্তু তিন মাত্রায় একে প্রমাণ করার কাজ বাকি ছিল। পেরেলম্যান এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। বার্কেলেতে থাকার সময়ে হ্যামিল্টনের বক্তৃতায় তিনি এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য অনুপ্রাণিত হন।

পেরেলম্যান এই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করার আগে হ্যামিল্টনের কাছে কাজটি যৌথভাবে করার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি একাই গবেষণা শুরু করেন। নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা-সহ নানা প্রলোভন ত্যাগ করে তিনি সম্পূর্ণরূপে গবেষণায় ডুবে যান। ‘ক্লে ম্যাথামেটিক ইন্সটিটিউট’ পুরস্কার ঘোষণার সময়েই তিনি এই সমস্যার সমাধানের দিশা পেতে থাকেন। ২০০২ সালের ১১ নভেম্বরে তিনি ইন্টারনেট আর্কাইভে তাঁর গবেষণাপত্র ‘The Entropy Formula for the Ricci Flow and its geometric application’ প্রকাশ করেন। এখানে তিনি পোঁকেয়ার কনজেকচারের সমাধান দেননি, কিন্তু কোন পথে এর সমাধান সম্ভব তার আভাস দিয়েছিলেন। তাঁকে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টোনি ব্রুক ক্যাম্পাস ও এম.আই.টি তে আহ্বান করা হয়। এই সময় তিনি দ্বিতীয় গবেষণাপত্র ‘Ricci Flow with surgery on three manifolds’ প্রকাশ করেন। এর পর আমেরিকা গিয়ে এম.আই.টি, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি।

সেখানে গবেষণা বা চাকরির প্রস্তাব ত্যাগ করে পেরেলম্যান সেন্ট পিটার্সবার্গ ফিরে আসেন। সেখানে তিনি তাঁর শেষ গবেষণাপত্র ‘Finite extinction time for the solutions to the Ricci flow on certain three manifold’ প্রকাশ করেন। এর পর বিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ করে Poincare Conjecture -এর সমাধান হিসেবে একে মেনে নেন। পেরেলম্যান তাঁর গবেষণাপত্রে থার্স্টন জিওমেট্রিজেশন কনজেকচারেরও সমাধান দেন। কিন্তু ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি আচমকাই পদত্যাগ করেন স্টেকলভ ইনস্টিটিউট থেকে। কারণ হিসেবে তিনি তাঁর তৎকালীন অনাসক্তির কথা বলেন। জ্যামিতিতে তাঁর অবদানের জন্য গ্রিগরি পেরেলম্যানকে ২০০৬ সালের অগস্ট মাসে গণিতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ফিল্ড মেডেল’ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথামেটিক্স।

এর আগে পেরেলম্যান ICM এর সভায় বক্তা হিসেবে থাকার প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিলেন। পেরেলম্যান এর পর, প্রথম গণিতজ্ঞ হিসাবে ফিল্ড মেডেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন গ্রেগরি পেরেলম্যান। ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথামেটিক্স ইউনিয়নের সভাপতি স্যার জন বল পেরেলম্যানের বাড়িতে গিয়ে টানা দু’দিন অনেক বুঝিয়েও তাঁর সিদ্ধান্ত বদল করাতে পারেননি। এরই মাঝে ঝু-জিপিং নাম এক চিনা গণিতজ্ঞ দাবি করেন তিনিই Poincare Conjecture সমাধান সঠিকভাবে করেছেন এবং পুরস্কারের দাবিদার তিনি। এর স্বপক্ষে তিনি ‘এশিয়ান জার্নাল অব ম্যাথামেটিক্স’ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ‘ক্লে ইনস্টিটিউট’ তাঁদের পুরস্কার দেওয়ার অনুষ্ঠান বিলম্বিত করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করেন। বিশেষজ্ঞ দল শেষ পর্যন্ত পেরেলম্যানকেই প্রকৃত সমাধানসূত্র প্রণেতা হিসেবে মেনে নেন। এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কারমূল্য ঘোষিত হয়। কিন্তু এই পুরস্কারও প্রত্যাখ্যান করেন পেরেলম্যান।

তিনি জানান বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্তকে তিনি সঠিক মনে করেন না। তিনি জানান ‘‘এই সমাধানের জন্য আমেরিকান গণিতবিদ্ হ্যামিল্টনেরও সমান অবদান। তাই তাঁকে বাদ রেখে আমার পুরস্কার নেওয়া সম্ভব নয়।’’ আজকের দিনে তাঁর এই সিদ্ধান্ত ‘সাফল্য’ আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। তিনি বলেন, ‘‘আমি গণিতে এমন কিছুই করিনি। পশুর মতো আমাকে চিড়িয়াখানায় প্রদর্শন করা হবে ও লোকে ভিড় করবে? সেটা আমি চাই না।’’

বিশ্ববিখ্যাত এই গণিতজ্ঞ বর্তমানে কোথায় কি করছেন তা নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট তথ্য আমাদের কারও কাছেই নেই। কেউ বলে তিনি নাকি তাঁর মায়ের সঙ্গে সেন্ট পিটার্সবার্গে এক ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। কারও কারও মতে গণিত ছেড়ে তিনি এখন ফুলচাষ, মাছ ধরা বা অপেরায় মগ্ন। আবার অনেকের আশা, পেরেলম্যান মেতে উঠেছেন নতুন কোনও সমস্যার সমাধানে। উপযুক্ত সমাধান মিললেই তিনি হয়তো আবার আমাদের সামনে হাজির হবেন।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement