প্রতীকী ছবি
বিয়ের মরসুম এসে গিয়েছে। আমরা যারা ষাট-সত্তরের জাতক তারা ছোটবেলায় বিয়ের নিমন্ত্রণপত্রের শেষে একটি লাইন দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। লেখা থাকত, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি আপ্যায়ন বিধি অনুসারে...’’। এ লাইনের মধ্যে লুকানো যে কথাগুলি ছিল তা হল, দেশে বড় দুর্দিন, একটু মেপেজুখে বিয়েতে খরচ করো ভায়া। বাড়িতে বিয়ের আগে রীতিমতো বাজেট মিটিং হত, সে মিটিংয়ে মাথাভারী পিসেমশাইরা অনেক ক্যালকুলেশন করে বিয়ের খরচের হিসেব কষতেন।
হঠাৎ কবে যেন সে সব বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের আশেপাশের বিয়েগুলো প্রাচুর্যে ভরে উঠতে শুরু করল। আমরা বিয়ের এলাহি ব্যবস্থা করার আগে ভাবা বন্ধ করে দিলাম যে, আমাদের দেশে ১৭ কোটি মানুষ দারিদ্র-সীমার নীচে বাস করে, কৃষকরা ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেন, কালাহান্ডির মা বাচ্চা বেচে দেন অর্থাভাবে।
কেন আমাদের চিন্তায় এই বদল এল? এমন তো নয় যে আমাদের ঘরে ঘরে কুবেরের ভাণ্ডার জমে উঠেছে! আসলে আমাদের সামনে মিথ্যে বৈভবের ছবি উপস্থিত করা হল। আমাদের সামনে এমন সব রত্নখচিত বিয়ের পোশাকের, ঘরের দেওয়ালে টাঙানো চিত্রকরের কল্পনার সিনারি থেকে উঠে আসা বিবাহবাসরের ছবি তুলে ধরা হল যে আমরা লোভী হয়ে পড়লাম। হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে বিয়ে ছিল এত দিন ‘যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব’-র মতো খানিকটা ব্যক্তিগত, খানিকটা সামাজিক একটি ব্যাপার। আজ হঠাৎ ব্যক্তি এবং পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে বিয়ে বাজারে গিয়ে পড়েছে। বিয়ে আর আমার পারিবারিক উৎসবমাত্র নেই, বিয়ে এখন ‘ইভেন্ট’। মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে, যেখানে আগের প্রজন্ম ‘‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি আপ্যায়ন’’ বিধি মেনে বিয়ে করেছে, সেই বাড়িতেও পরের প্রজন্ম ‘ডেস্টিনেশন ম্যারেজ’-এর কথা ভাবে, এক বোন আর এক বোনকে ঠাট্টা করে বলে, ‘‘কী রে, কোথায় বিয়ে করবি? টাস্কানি?’’ ‘‘বিয়েতে কী পরবি? সব্যসাচী?’’
অবশ্যই সাম্প্রতিক কালে অনেকাংশে এই দায় বলিউডের তারকাদের, ক্রিকেট খেলোয়াড়দের এবং ধনকুবের শিল্পপতি, বণিকদের উপর পড়ে। তাঁরা যে ভাবে বিয়েকে ঘিরে ধনদৌলতের চমক দেখাচ্ছেন, বাজারকে তাঁদের ব্যক্তিগত মুহূর্ত বিক্রি করছেন, তাতে আমাদের মতো মানুষের মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। তাঁরা যখন তাঁদের বিয়ের ছবি নামী পত্রিকার প্রচ্ছদে ছেপে ‘জাস্ট আস’ বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেন, তখন কিন্তু তাঁরা ‘জাস্ট আস’ নন, তাঁরা তখন পাঠককুলের সম্পত্তি। ধনকুবের শিল্পপতির বাড়ির বিয়ের মুহূর্ত যে ভাবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে, সম্পদের যে রূপ সেখানে ঠিকরে বেরোচ্ছে, হিলারি ক্লিন্টনকে আরতি করতে দেখা যাচ্ছে, স্বপ্নে দেখা নায়কনায়িকাদের সে বিয়েতে খাবার পরিবেশন করতে দেখা যাচ্ছে, সে সব দেখে আমাদেরও সাধ জাগছে ও ভাবেই নিজেদের জীবনের বিশেষ ঘটনাকে বাজারজাত করার।
আমাদের জীবনের ঘটনা কিন্তু বাজারে কাটবে না। আমাদের বিয়েতে বিয়ন্সে নাচবেন না, দেশের সর্বোচ্চমানের সঙ্গীত শিল্পী মন্ত্রোচ্চারণ করবেন না, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আমাদের বিয়ের ছবি ছাপা হবে না। কিন্তু স্বপ্নের গরু মহাকাশে ওঠে। তাই সাধ্যের বাইরে গিয়ে, ব্যাঙ্ক লোন করে আমরা বিয়েতে জাঁক করব। মেয়ের বায়না অনুযায়ী হিরে কিনতে বাবা-মা জীবনের কষ্টার্জিত সব সঞ্চয় উপুড় করে দেবেন, ছেলের শখের স্যুট কিনতে গিয়ে অভিভাবক দেউলিয়া হয়ে যাবেন। অর্থাৎ বাজার আমার রোজগার, সঞ্চয় এবং ধার-করা টাকা আত্মসাৎ করবে। সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে ঘুম থেকে জাগাবে আর ঘুম পাড়াবে।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা প্রায়ই শুনি। সেলেব্রিটিরা যা করছেন, নিজেদের রোজগারে করছেন। তা করছেন, কিন্তু সেই আয়ের প্রক্রিয়াটিতে কি বড় রকমের অনৈতিকতা নেই? কাজ বা শ্রমের সঙ্গে আয়ের কোনও সাযুজ্য নেই— এমনই এক ব্যবস্থায় আমাদের বাস। আকাশছোঁয়া অসাম্যে যার প্রতিফলন। সেটা কি ধর্তব্য নয়?
আর একটা যুক্তি শোনা যায় যে, সেলেব্রিটিরা গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন নাগরিক, তাঁদের বিয়ে তাঁরা কী ভাবে করবেন সেটা তাঁদের চয়েস। নিশ্চয়ই। কিন্তু নাগরিক দায়িত্ব বলেও একটা বস্তু আছে। তারকারাও সেই দায়িত্ব থেকে মুক্ত নন। অথচ আমাদের সেলেবদের অনেককে দেখেই মনে হয়, দেশের নাগরিক হিসেবে সহনাগরিকদের প্রতি তাঁদের কোনও দায়িত্ববোধের বালাই নেই।
তবে সব দোষ তাঁদের নয়। তাঁদের সেলেব্রিটি বানাল কে? বলিউডে হোক, ওয়াংখেড়েতে হোক, বাণিজ্যে হোক, তাঁরা তো করে-কম্মে খান, ঠিক যেমন মাঠে ফসল ফলান কৃষক, খনি থেকে কয়লা তোলেন শ্রমিক, কিংবা বাবুদের বাড়িতে বাসন মাজেন সুবলার মা। সিনেমায় অভিনয়ে কিংবা ক্রিকেটের ময়দানে খেলাধুলো করার এত চাকচিক্য কে তৈরি করল? অবশ্যই এই দায় মিডিয়াকে নিতে হবে। কিন্তু শুধু মিডিয়ার দায় বলে হাত ধুয়ে নিলে তো চলবে না বাপু। আমরা দেখি বলেই মিডিয়া এ সব প্রকাশ করে। আমরাই তাঁদের জীবনের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ক্রেতা। অতএব দায় আমাদেরও।
এই দায় আমাদের স্বীকার করা দরকার। স্বীকার করা দরকার যে, দেখনাই আর আদেখলেমোর সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করেছে। ব্যক্তিগত পছন্দের নামে নিজেদের সঁপে দিয়েছি বাজারের হাতে। আর সেই বাজারের লাটাই শিল্পপতি, ব্যবসায়ী আর তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকা তারকাদের হাতে। আমরা ভাবছি বটে বিয়ে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি সেখানে যত খুশি টাকা খরচ করব। কিন্তু একটু গভীরে ভাবলেই বুঝতে পারব, আমি নিজের খুশিমতো কিছুই করছি না। ওই ওঁদের পথেই চলছি। স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতাটি ওঁদের হাতে তুলে দিয়েছি। চোখ বাঁধা বলদের মতো ওঁদের পিছনে ছুটে মরছি। পার্থক্য একটাই, বলদের চোখ কলু বেঁধে দিয়েছিল, আমাদের চোখ আমরা নিজেরাই বেঁধেছি।