প্রতীকী ছবি।
বহু সদিচ্ছাময় মানুষ সমাজের ভাল করিতে চাহেন, সমাজের দুর্দশার পানে চাহিয়া আন্তরিক দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু নিজে অগ্রসর হইয়া ইতিবাচক কিছু করিতেছেন না কেন, জিজ্ঞাসা করিলে হস্তে অসহায়তার মুদ্রা করিয়া বলেন, একা আর কতটুকুই বা করা সম্ভব। বিলাপ করেন: এই হতভাগ্য সমাজে ভাল কিছু করিতে যাইলেই অসংখ্য প্রতিকূলতা চতুর্দিক হইতে ঘিরিয়া ধরে, বহু দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থে ঘা লাগিয়া যায়, সেই অসৎ সমষ্টি আসিয়া সহজেই একক উদ্যমী ব্যক্তিকে পিষিয়া দেয়। সেই কারণে এমনকী নিজ কর্তব্যও যথাযথ পালন সম্ভব হয় না, কেবলই চরিত্রের বিরুদ্ধে গিয়া অসংখ্য আপস করিতে হয়। এই কথাগুলির বর্মে যে ব্যক্তিটি নিজ কর্মহীনতার ক্ষেত্র প্রশস্ত করিতেছেন, সমাজের অচলাবস্থাকেই পোক্ত-তর করিতেছেন, তাহা প্রায় লক্ষিত হয় না। কিন্তু যখন এক জন ব্যক্তি তাঁহার সততা সংকল্প অধ্যবসায় পরিশ্রমে ভর করিয়া শিকারপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অবস্থা সম্পূর্ণ বদলাইয়া দেন, তখন এই সত্য ভাসিত হয়: সম্ভাব্য কু-পরিণতির কথা ভাবিয়া কর্তব্য হইতে পিছাইয়া যাওয়া প্রত্যেকের ধর্ম নহে বলিয়াই সমাজ এখনও চলিতেছে। শিকারপুর এক প্রান্তিক অঞ্চল, ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্যকেন্দ্র সেইখানে ধ্বংসস্তূপ হইয়া পড়িয়া ছিল, হইয়া উঠিয়াছিল দুষ্কৃতীদের অবাধ চারণক্ষেত্র। ২০১১ সালে শঙ্কর রায় ডাক্তারি করিতে আসেন এইখানে, তিনি আবাসনে থাকিতে আসিবার পর দুষ্কৃতীরা তাণ্ডবও চালায়। কিন্তু তিনি না পলাইয়া, ক্রমাগত উন্নতি করিবার চেষ্টায় লাগিয়া পড়েন।
এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র এখন পরিচ্ছন্ন, সুন্দর, কর্মময়। রোগীরা পাইতেছেন সযত্ন পরিষেবা, যাহা তর্জনহীন, বন্ধুত্বপূর্ণ। উন্নতি হইতেছে, আরও পরিকল্পনা রহিয়াছে। শঙ্করবাবুর পাশে দাঁড়াইয়াছেন স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক প্রশাসন, সাধারণ মানুষ। অথচ শঙ্করবাবু নিজেকে বিপন্ন না-ই করিতে পারিতেন, সেই আত্মরক্ষার অধিকার তাঁহার ছিল। স্ত্রী ও পাঁচ বৎসরের সন্তানকে লইয়া তিনি কেন সেই গৃহে থাকিবেন, যাহা ভাঙচুর করিয়াছে কিছু অপরাধী? কিন্তু ওই সহজ সমাধানটি না লইয়া যেই তিনি কাজে ব্রতী হইয়াছেন, অন্য কেহ কী করিতেছে সেই দিকে না তাকাইয়া তাঁহার নিজের কী করা উচিত সেই বিষয়ে যত্নবান হইয়াছেন, না-করিবার অসংখ্য প্রচলিত যুক্তির দিকে ঝুঁকিবার পরিবর্তে ঝুঁকি সত্ত্বেও কাজটি করিবার দিকে পা বাড়াইয়াছেন, তখনই সুফল ফলিতে আরম্ভ করিয়াছে। প্রত্যেকেই যদি আদর্শ পরিস্থিতির অপেক্ষায় বসিয়া থাকেন ও ভাবেন নিজ ক্ষমতাকে উর্বরতম ক্ষেত্র ব্যতীত ব্যবহার করিব না, কোনও দিনই আগাছা কাটিয়া আবাস পত্তন করা যাইবে না। সমাজ তো লুডোর ছক নহে যে রঙিন প্রান্তরে নির্দোষ ঘুঁটি-চালাচালি হইবে। তাহা বুঝিয়া, বহু বাধার সম্মুখীন হইতে হইবে জানিয়া, নিজ দায়বদ্ধতাকে অঙ্গীকারে ঘিরিতে হইবে। সম্ভাব্য জুজু দেখাইয়া নিরাপদ কক্ষে সুড়সুড়াইয়া প্রত্যাবর্তন করিলে, উত্তেজিত আড্ডা বিনা লাভ হইবে না। নিজ ব্যর্থতা বা নিশ্চেষ্টতার দায় অবশিষ্ট বিশ্বের স্কন্ধে চাপাইয়া দিবার অভ্যাস ছাড়িয়া, গড় বাঙালি যদি শঙ্করবাবুর উদাহরণে প্রাণিত হন, হয়তো ‘একলা চলো রে’ কেবল জলসায় আবেগকম্পন হইয়া রহিয়া যাইবে না।