রানিবাঁধের ছেঁন্দাপাথরে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর স্মৃতি বিজড়িত জায়গায় তাঁর আবক্ষ মূর্তি। ছবি: লেখক
স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঁকুড়ার মানুষের বিশেষ কৃতিত্ব থাকলেও, আন্দোলনের ক্ষেত্র হিসেবে অন্য জেলার মতো এই জেলা ইতিহাসের পাতায় ততটা গৌরবোজ্জ্বল স্থান পায়নি। যেখানে আন্দোলনে পাশের জেলা মেদিনীপুর বা মানভূম অগ্নিগর্ভ হয়েছে, সেখানে বাঁকুড়া ততটা উজ্জ্বল নয়। বিশেষ করে সশস্ত্র আন্দোলনে। অহিংস আন্দোলনের প্রভাব বাঁকুড়ায় তুলনামূলক ভাবে বেশি ছিল।
তবে বিপ্লবীরা গোপন ঘাঁটি গড়ার জন্য বাঁকুড়াকে যে আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তাতে দ্বিমত নেই। বাঁকুড়ার প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, নরেন গোস্বামী, বিভূতি সরকার প্রমুখেরা রানিবাঁধ থানার ছেঁদাপাথরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি গুপ্তঘাঁটি তৈরি করেছিলেন, যার পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন অম্বিকানগরের রাজা রাইচরণ ধবল। সেখানে লুকিয়ে রাখা হত বিভিন্ন প্রকারের আগ্নেয়াস্ত্র। বৈপ্লবিক কার্যকলাপ চালানোর জন্য সে সময়ে জায়গাটি ছিল নিরাপদ। বিখ্যাত বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর সঙ্গেও এই গুপ্ত ঘাঁটির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অনুশীলন তত্ত্ব’-র আদর্শ অনুযায়ী, ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের সভাপতিত্বে কলকাতায় প্রথম বিপ্লবীকেন্দ্র ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠা পায়। পরবর্তীতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ঋষি অরবিন্দ ঘোষ ও অন্য বিপ্লবীদের সহযোগিতায় এই সমিতি বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে, যে বিস্তার থেকে বঞ্চিত হয়নি বাঁকুড়াও।
সুদূর চট্টগ্রামের বিপ্লবী চারুবিকাশ দত্ত এবং সেই সঙ্গে বিপ্লবী নীরদবরণ দত্ত ও প্রফুল্ল কুণ্ডুর তত্ত্বাবধানে বাঁকুড়ায় গড়ে ওঠে ‘অনুশীলন সমিতি’র প্রাথমিক সংগঠন। চারুবিকাশ দত্তের প্রত্যক্ষ চেষ্টায় বাঁকুড়ার বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয় বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গোষ্ঠী। সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল মালিয়াড়ার গোষ্ঠীটি। নীরদবরণ দত্ত নিজে সেখানকার স্কুলে ব্যায়াম শিক্ষা দিতেন। তাঁরই হাত ধরে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন বিজয় তিওয়ারি, চিন্তাহরণ তিওয়ারি ও প্রভাকর বিরুনি।
পরবর্তী কালে প্রভাকর বিরুনির নেতৃত্বে মালিয়াড়ায় গড়ে ওঠে আটটি ব্যায়াম সমিতি ও চারটি পাঠাগার। এই সমিতিগুলি ছিল বিপ্লবীদের গুপ্ত আস্তানা। বেশির ভাগ ফেরারি বিপ্লবীরাই গা ঢাকা দিতেন সেখানে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরে, বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী বেশ কিছু দিনের জন্য আত্মগোপন করে ছিলেন মালিয়াড়ার এই গুপ্ত আস্তানায়। খাস বাঁকুড়া শহরেও ছিল ‘অনুশীলন সমিতি’র গুপ্ত শাখা, যার সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন বিপ্লবী প্রফুল্ল কুণ্ডু, বিষ্ণুপুরের ষষ্ঠীদাস সরকার ও দিবাকর দত্ত।
‘যুগান্তর’ দলেরও শাখা-সংগঠন ছিল বাঁকুড়ায়। তার মধ্যে বেশ সক্রিয় ও শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল বিষ্ণুপুর ও আশপাশের সংগঠনগুলি। বিপ্লবী বিমল সরকার, মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন সরকার, সিদ্ধেশ্বর সাঁই, সুধাংশু দাশগুপ্ত প্রমুখ ছিলেন এই সব সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। বিপ্লবী বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের ‘যুগান্তর’ দলের কেন্দ্রগুলির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। বিষ্ণুপুরের কাছে রাধানগরে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন কিছু দিন। বহু নতুন যুবকদের দলে টেনে চাঙ্গা করে তুলেছিলেন গুপ্ত কেন্দ্রগুলিকে। কাছেই পাচালের জঙ্গলে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর শিক্ষাও দিতেন সে সময়।
এখানকার ‘যুগান্তর’ দলের কর্মীরা গুপ্ত কেন্দ্রগুলিকে অস্ত্র ও আর্থিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করে তোলার জন্য ডাকাতি শুরু করেন। তেমন কিছু ক্ষেত্রে বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ সশরীরে উপস্থিত ছিলেন।
বাঁকুড়া শহরের কালীতলার কাছে ‘রামদাসের আখড়া’ নামে একটি গুপ্ত ব্যায়ামাগার তৈরি হয়েছিল। ওই আখড়াই ছিল বিপ্লবীদের অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ছেঁদাপাথরের গোপন ঘাঁটির কথা ব্রিটিশ সরকারের কানে পৌঁছলে, তা আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয় কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টকে। কিন্তু টেগার্ট ছেঁদাপাথরের গুপ্তঘাঁটি আক্রমণে ব্যর্থ হন এবং ফেরার পথে রামদাসের আখড়ায় অতর্কিতে তল্লাশি চালান। ধরা পড়ে যান বিপ্লবী রামদাস চক্রবর্তী, গোকুল মিত্র, অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
এ ছাড়া, আরও কিছু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ছিল, যেগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ভ্রাতৃ সঙ্ঘ’ ও ‘অভয় আশ্রম’। কুমিল্লা অভয় আশ্রমের সক্রিয় কর্মী সুশীলচন্দ্র পালিত ও জগদীশ পালিতের মামা নৃপেন্দ্রনাথ বসু বাঁকুড়া অভয়াশ্রমের একটি শাখা সংগঠন স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে জেলার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিশিষ্ট কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এই অভয়াশ্রম।
কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, জেলার এই সমস্ত গুপ্ত সমিতি, সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কথা দু’মলাটের মধ্যেই সীমিত হয়ে রয়েছে। খুব কম মানুষই আছেন যাঁরা এ সব বিষয়ে অবগত। অনেকেই হয়তো বৃহত্তর ভাবে এই সমস্ত সংস্থা-সমিতির নাম শুনে থাকবেন, কিন্তু বাঁকুড়ার মানুষ কী ভাবে এই সমস্ত সমিতিগুলি সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন, তার বিশেষ তথ্য হয়তো তাঁদের কাছে নেই। এর মূল কারণ একটাই— মূল ইতিহাস নিয়ে যতটা পর্যালোচনা করা হয়, জেলার ইতিহাস নিয়ে ততটা জোর দেওয়া হয় না। ব্যক্তিগত আগ্রহ ছাড়া, জেলার ইতিহাস চর্চা করার পরিধিও খুব কম। প্রত্যেক মানুষের সামগ্রিক ইতিহাস জানার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার ইতিহাসও জানা প্রয়োজন। তাই মূল ধারার ইতিহাস চর্চার পাশাপাশি, স্থানীয় ইতিহাস চর্চাও অত্যন্ত জরুরি।
লেখক ইঁদপুরের সাহিত্যকর্মী