বন্ধুর-পন্থা: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কলকাতা আগমন উপলক্ষে শহরের রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল, ১১ জানুয়ারি। পিটিআই
নিজের দলের হাতে থাকা রাজ্য অসমে যেতে পারেননি নরেন্দ্র মোদী। বিক্ষোভের ভয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বিজেপি-শাসিত অসম সফর বাতিল করতে হয়েছে। সেখানে তাঁর নিজের দলের সরকারই তাঁর উপযুক্ত নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারেনি। কিন্তু কলকাতা ভ্রমণে মোদীকে কোথাও বাধা পেতে হয়নি। জল-স্থল-অন্তরিক্ষ ঘুরে ঘুরে তিনি নিজের কর্মসূচি পূর্ণ করতে পেরেছেন। এমনকি, বেলুড় মঠ এবং কলকাতা বন্দরের সরকারি মঞ্চ ব্যবহার করে রাজনীতিও করে গিয়েছেন পুরোমাত্রায়।
মোদীর সফর মসৃণ থাকার জন্য রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী যা করেছেন, সেটা তাঁর যোগ্য কাজ। যাকে বলে, সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন কোনও রাজ্যে সরকারি সফরে যান, তখন তিনি কোন দলের সেটা বিচার্য হয় না। সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের কর্তব্য হয়, প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারী ব্যক্তির নিরাপত্তা এবং নির্বিঘ্নে সকল কর্মসূচি পালনের বন্দোবস্ত নিশ্চিত করা। বাংলার সরকার সেটাই করেছে।
সন্দেহ নেই, বিক্ষোভকারীদের নাগাল বাঁচিয়ে মোদী কোনওক্রমে তাঁর ‘কার্যসিদ্ধি’ করে উড়ে যেতে পারলেও তাঁর এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষের আঁচ থেকে বাঁচতে পারেননি। বস্তুত ‘গো ব্যাক মোদী’ স্লোগান দিয়ে কলকাতা যে ভাবে বিক্ষোভের প্লাবন দেখাল, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে ভাবে সেই অসম্মানের বার্তা পেতে হল, তাতে জল মাপতে ভুল হওয়ার কথা নয়!
নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বেলুড় মঠের মতো শান্ত নিরুপদ্রব জায়গায় দাঁড়িয়ে মোদী অবশ্য বিনা বাধায় তাঁর ‘জবাবি’ রাজনীতিটা করতে পেরেছেন। এই ধরনের রাজনীতি তাঁর ধাতে আছে। এর আগে বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে গিয়ে সভাস্থলে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান শুনেও নির্বিকার থেকে তিনি বিতর্ক উস্কে দিয়েছিলেন। এ বার বেলুড় মঠ থেকে রাজনৈতিক ভাষণ! মঠের পবিত্র আবহ এতে ক্ষুণ্ণ হল কি না, তাতে মোদীর হয়তো বিশেষ কিছু আসে-যায় না। কিন্তু বেলুড়ে মুষ্টিমেয়র করতালি ধর্মতলার বিক্ষোভের গর্জনে ঢাকা পড়তে বাধ্য।
সে দিনের বিক্ষোভকারীদের একটি বড় অংশ ছিল বামপন্থী। শুধু সিপিএম নয়, ছিল অন্যান্য বাম ছাত্র সংগঠনও। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসা ওই পড়ুয়াদের পাশে সিপিএম নেতাদের সঙ্গেই দেখা গিয়েছে কংগ্রেস নেতাদেরও।
সাম্প্রতিক রাজ্য রাজনীতির নিরিখে এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ প্রথমে বন্ধ ডেকে, তার পরেই মোদীর সফর চলাকালীন কলকাতার প্রাণকেন্দ্র অবরোধ করে সিপিএম এবং কংগ্রেস হঠাৎ যেন নাগরিকত্ব-আন্দোলনে একটি সমান্তরাল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করল। মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই নিজেদের ‘সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদী’ বলে প্রতিষ্ঠিত করা।
আপাত ভাবে দেখলে রাজনীতির ‘ধর্মে’ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটা বা স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়া নিতান্ত তুচ্ছ ব্যাপার! রাজনীতির কারবারিরা কেউ এ সব নিয়ে মাথা ঘামায় না। যে কোনও সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের আন্দোলনের এটাই চেনা চরিত্র। এতে ডান-বাম কারও কোনও ফারাক নেই।
কিন্তু এখন কেন্দ্রের সিএএ, এনআরসি-র বিরুদ্ধে বন্ধ সফল করার নামে রাজ্যে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে দেওয়ার পিছনে অন্য এক কৌশলও কাজ করছে। সিপিএম এবং কংগ্রেস তাই সুচিন্তিত ভাবেই এই পথ নিয়েছে।
আসলে তারা জানে, নাগরিকত্বের সঙ্কট নিয়ে মমতার বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করার জায়গা নেই। এই রাজ্যে নাগরিকত্ব-আন্দোলনে বরং সবার আগে এবং সবচেয়ে জোরালো ভাবে নেমেছেন মমতাই। লোকসভা ভোটের অনেক আগেই অসমে খসড়া নাগরিক পঞ্জিতে ৪০ লক্ষ লোকের নাম বাদ পড়ার সময় থেকে তাঁর প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। অন্যরা তখন অনেক পিছিয়ে।
পরিস্থিতি আজ বহু দূর গড়িয়েছে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো কার্যত ধ্বংস করে নয়া নাগরিকত্ব আইন বলবৎ হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জির মাধ্যমে ‘ভারতীয়ত্ব’ প্রমাণের হুমকিতে উদ্বেগ বাড়ছে। দেশ জুড়ে উত্তাল আন্দোলনের মুখে রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে মরিয়া মোদী-অমিত শাহেরা।
মমতাও ক্রমশ আন্দোলনের মাত্রা চড়িয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে মিছিল, সমাবেশ, অবস্থান চলছে একটানা। একই দাবিতে বাম, কংগ্রেস এবং অন্য বহু সংগঠন প্রতিবাদের পথ নিয়েছে। সবারই দাবি—সিএএ, এনআরসি, এনপিআর বাতিল করতে হবে। অথচ বন্ধ সফল করার নামে অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হওয়ার পরে দেখা গেল, আন্দোলনের অভিমুখ রাজ্যের দিকেও ঘুরিয়ে দেওয়া গিয়েছে।
ওই বন্ধের বিরোধিতা করতে গিয়ে মমতা সে দিন বলেছেন, ‘ওরা ঘোলা জলে মাছ ধরতে চায়।’ ভেবে দেখলে কথাটি একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটকে মাছের চোখ ধরলে সেই মাছ ধরতে চাওয়ার চেষ্টা সিপিএম এবং কংগ্রেসের আছে। আবার একই কারণে ওদের জালে সেই মাছ যাতে ধরা না পড়ে, সে জন্য মমতাও বাড়তি সতর্ক। মুঠি শক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর।
সংঘাতের মূল জায়গাটি তৈরি হয়েছে এখানে। তাই কংগ্রেসের ডাকে সিপিএমের সঙ্গে বসে দিল্লিতে বিরোধী বৈঠক শেষ পর্যন্ত বর্জন করলেন তিনি। ডাক দিলেন একলা চলার। তাঁর কাছে জাতীয় রাজনীতির চেয়ে আগামী বিধানসভা ভোট এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক যেমন দিল্লির নির্বাচন সামনে আছে বলে কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গাঁধীর বৈঠকে ডাকই পায়নি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টি।
এখানে ভোটের বাক্সে সিপিএম এবং কংগ্রেস দুই দলেরই জনসমর্থন হুহু করে কমেছে। আর বিজেপির উত্থান এবং প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় আসার পরে রাজ্যে লড়াই মূলত দ্বিমুখী হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক ভোট ভাগাভাগির ছবিটিও ইদানীং পরিষ্কার বোঝা যায়। বাংলায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট আঁকড়ে রাখা আজ তৃণমূলের কাছে তাই জীবনপণ সংগ্রাম। তার জন্য সব রকমে সিএএ, এনআরসি-র বিরোধিতা এখন মমতার হাতে সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র। কারণ এতে সংখ্যালঘুরাই বেশি শঙ্কিত। বিজেপির বিরুদ্ধে নাগরিকত্বের আন্দোলন যত দূর সম্ভব তীব্র করে মমতা সেই ভোটব্যাঙ্ক নিজের হাতে রাখতে তৎপর হবেন, এটাই স্বাভাবিক।।
একই ভাবে রাজ্যে কংগ্রেস, সিপিএম-ও মনে করছে, বিজেপির এই চাপের দিনে সংখ্যালঘুদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনের দামামা বাজালে কিছুটা ভোট হয়তো তারাও টানতে পারবে। তাই মঞ্চের আলোয় আসার তাগিদে নাগরিকত্ব আন্দোলনের নামে তারা আপাতত দু’টি কৌশল নিল। এক দিকে জোর করে বন্ধ ‘সফল’ করার জন্য জনজীবন বিঘ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে নিজেদের উপস্থিতি জাহির করা যায়। অন্য দিকে প্রশাসন বন্ধ ব্যর্থ করতে নামায় মমতাকে বিতর্কিত করে তোলা। যাতে সংখ্যালঘুদের কিছুটা অন্য রকম বোঝানো যায়।
কার উদ্দেশ্য কী ভাবে কতটা সফল হবে, সেটা পরের কথা। কিন্তু একটা জরুরি প্রশ্ন থেকেই যায়। ডুবন্ত ব্যাঙ্কে কি কেউ টাকা রাখতে চান? রাজ্যে সিপিএম-কংগ্রেস একজোট হলেই আগামী ভোটে তারা ক্ষমতায় আসবে— এটা সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ বিশ্বাস করেন কি?
উত্তরটা নিশ্চয়ই সকলের জানা। তা হলে সংখ্যালঘুরাই বা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে চাইলে সেটা জলে ফেলার মতো হঠকারী কাজ করবেন কেন! তাতে আখেরে লাভবান হবে কে? পরোক্ষে বিজেপিই যে তার সুবিধা পেয়ে যাবে, সেটা বুঝতে রকেট-বিজ্ঞান পড়তে হয় না। মানুষ এত বোধহীন নয়।