‘মিশন মঙ্গল’-এর দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
গাঁধী পদবি তোমার, অথচ বলছ, তুমি অনাথ?— পরমেশ্বর জোশী প্রশ্ন করেছিলেন একা গাঁধী-কে। দু’জনেই বিজ্ঞানকর্মী, বেঙ্গালুরুতে ইসরো-র মঙ্গলগ্রহ-অভিযানের সঙ্গে যুক্ত। বছর কয়েক আগে, এই দশকের গোড়ার দিকে তখন মার্স অরবিটার মিশন সফল করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। ঠিকুজি-কুলজিতে বিশ্বাসী গোঁড়া হিন্দু পরমেশ্বরের প্রশ্নের উত্তরে একা বলেছিলেন: অনাথ আশ্রমে আমাদের সকলেরই পদবি ছিল গাঁধী, তিনি যে জাতির জনক!
১৫ অগস্টে মুক্তি পেয়ে, কয়েক দিন আগে পর্যন্তও কলকাতায় চলছিল ছবিটা, ‘মিশন মঙ্গল’। পঞ্চাশ বছর আগে ওই স্বাধীনতা দিবসেই ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইসরো। ছবির লেখক ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আর বালকি তাঁর রচিত ছবিটাতে যেন একটু আচমকাই গাঁধী-প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে এলেন। গাঁধীজির জাতি গড়ার স্বপ্নের সঙ্গে মহাকাশ জয়ের স্বপ্নকে মেলানোর জন্যেই শুধু, না কি জাতীয়তাবাদের প্রকৃত কর্তব্যের দিকে আমাদের মনোযোগ ঘোরানোর জন্যেও?
জাতীয়তাবাদের প্রধান কাজই হল সমস্ত নাগরিকের সমতা প্রতিষ্ঠা করা, তাদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা, প্রত্যেককে নিজের স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী বাঁচতে দেওয়া। একা গাঁধী যেমন অসম্ভব স্বাধীনচেতা, পোশাক থেকে পুরুষ নির্বাচন পর্যন্ত সব ব্যাপারেই। পরমেশ্বরের সঙ্গে যদি সমান সম্মানে না বাঁচতে পারেন একা, তবে নাগরিক হিসেবে কী ভাবেই বা মঙ্গলাভিযানে শামিল হবেন তিনি? ‘মিশন মঙ্গল’-এ বিজ্ঞানকর্মীদের মধ্যে মেয়েরাই ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়, পুরোভাগে ছিলেন তারা শিন্ডে, তারা-একা ছাড়াও ছিলেন কৃতিকা আগরওয়াল, বর্ষা পিল্লাই, নেহা সিদ্দিকি।
যাঁদের আদলে এই চরিত্রেরা তৈরি, সেই বিজ্ঞানীরা হলেন নন্দিনী হরিনাথ, রিতু কারিধাল, অনুরাধা টিকে, মৌমিতা দত্ত, সীতা সোমাসুন্দরম, মিনাল রোহিত প্রমুখ। ঠিক পাঁচ বছর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর যখন মঙ্গলাভিযানে ভারতের চূড়ান্ত সাফল্য এল, বিস্তর হইচই হয়েছিল এঁদের নিয়ে, বিবিসি-তে খবরই হয়েছিল: ‘দ্য উইমেন সায়েন্টিস্টস হু টুক ইন্ডিয়া ইনটু স্পেস’। বালকি-র ছবিতেও সে ছাপ স্পষ্ট। কত অস্বাচ্ছন্দ্যের ভিতর দিয়ে তারা-একা-কৃতিকা-বর্ষা-নেহা কাজ করে গিয়েছেন, রোজই কিছু-না-কিছু সমস্যা লেগেই থাকত। কারও স্বামী সারাক্ষণ সংসারে নিজের শাসন বজায় রাখায় ব্যস্ত, কারও স্বামী অসুস্থ, কারও শাশুড়ি পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য গঞ্জনা করে চলেছেন, কারও স্বামী ছেড়েই চলে গিয়েছেন। এত ঝঞ্ঝাটেও এঁরা হাসিমুখে সব দিক সামলে প্রতি দিন ঝাঁপিয়ে পড়তেন মঙ্গলাভিযানে। ছবির শেষে যখন সে অভিযান সফল হল, প্রবীণ বিজ্ঞানী অনন্ত আয়েঙ্গার তাঁদের প্রকল্পের অধিনায়ক রাকেশ ধওয়নকে বলেছিলেন: ‘‘ভাগ্যিস মিশনটার নাম রেখেছিলেন ‘মম’, তাই সাফল্য এল, ‘ড্যাড’ রাখলে আর আসত না।’’
বালকি অবশ্য মানতে নারাজ যে ‘মিশন মঙ্গল’ একটি নারীকেন্দ্রিক ছবি, কারণ হিসেবে যুক্তিটিও পেশ করেছেন মোক্ষম: ‘‘মেয়েরা তো এমনিতেই পুরুষের চেয়ে অনেক উপরে, অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। কেন আমি হঠাৎ আবার নতুন করে তাদের ‘ক্ষমতায়ন’-এর চেষ্টা করতে যাব?’’ একই বক্তব্য গাঁধীজিরও, কর্মে নিজেকে উৎসর্গ করার প্রতিমূর্তি রূপে নারীকে দেখতেন তিনি, নৈতিক দিক থেকেও মেয়েরা তাঁর কাছে অপরিমেয় শক্তির আধার, বলেছিলেন ‘‘নিঃস্বার্থ কর্মে পুরুষ কখনওই নারীর সমকক্ষ হতে পারবে না।’’
হিন্দু-মুসলমান প্রসঙ্গটিও একটু যেন খেলাচ্ছলে ছবিতে ঢুকিয়ে দেন বালকি। যেমন নেহা বিবাহ-বিচ্ছিন্ন এবং মুসলমান বলে একা থাকার জন্যে ঘরভাড়া পান না, তাঁকে সন্তানবৎ স্নেহে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখেন সহকর্মী অনন্ত আয়েঙ্গার— নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ বিজ্ঞানী। আবার তারা-র ছোট ছেলের কাছে আইকন এ আর রহমান, তাই সে কোরান পড়ে, দাড়ি রাখে, সুফি-গান গায়, মঙ্গলগ্রহের উর্দু প্রতিশব্দ আওড়ায়, বলে— উর্দু কবিদের ভাষা। বাবার প্রচণ্ড বকুনি সত্ত্বেও সে অবাধ প্রশ্রয় পায় মা-র কাছ থেকে। ধর্মপ্রাণ হিন্দু হলেও তারা যে মঙ্গলাভিযানের নেশায়-মাতা বিজ্ঞানী!
রোজকার কঠিন শ্রমে আমাদের জীবন তো এক আত্মবিস্মৃত যাপনেই অবসিত হতে থাকে প্রতি দিন, তখন এ রকমই দেখা কোনও ফিল্ম বা পড়া কোনও বই আমাদের দৈনন্দিনের সেই বিস্মৃতি মুছে জাতীয় জীবনের যৌথ স্বপ্নের কাছে নিয়ে যায় কখনও কখনও। ১৯৬৯-এ ইসরো-র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে শতবর্ষও পূর্ণ হয়েছিল গাঁধীজির। রেজাউল করিম-এর ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যা ও গাঁধীজি’ প্রকাশ পেয়েছিল সে-বছর, ‘গাঁধী শতাব্দী পুস্তকমালা’ সিরিজ়ের নবম পুস্তক ছিল এটি— এত কাল পর সার্ধশতবর্ষে সেটি পুনঃপ্রকাশ করল সূত্রধর। তাতে গাঁধীজি বলছেন: ‘‘আমি সমগ্র জীবন ধরিয়া এমন এক ভারতবর্ষ গঠন করিতে চাহিয়াছি, যেখানে বর্ণ, ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের সমান অধিকার থাকিবে। আমার ধ্যানের ভারতবর্ষ সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হইবে। এই ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অকৃত্রিম প্রীতি ভালোবাসা ও সদ্ভাব রক্ষা করিয়া চলিবে।’’
আজ, ঠিক এই সময়টায়, কথাগুলি একটু মনে রেখে দেওয়া দরকার নয় কি?