কয়েক দিন আগে, অমর্ত্য সেনকে মেঘালয়ের রাজ্যপাল মশাই মনে করিয়ে দিয়েছেন, রামরাজাতলা বা শ্রীরামপুর ইত্যাদি জায়গার অস্তিত্বই বলে দেয়, পশ্চিমবঙ্গে ‘জয় শ্রীরাম’ কোনও নতুন বিষয় নয়। এও বলেছেন, অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তিনি না-হয় সেই বিষয়েই কথা বলুন। শ্রীযুক্ত রায় একা নন। বহু মানুষের বক্তব্য জানা গেল এর মধ্যে। ‘জয় শ্রীরাম’ বাঙালির প্রচলিত সম্ভাষণ-বাক্য নয় বলে অমর্ত্য সেন অন্যায় করেছেন, এমনই তাঁরা ভাবেন।
অর্থনীতির পণ্ডিতকে যাঁরা অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়ে মাথা গলাতে বারণ করেন, তাঁদের বিষয়ে বেশি কথা বলার মানে হয় না— এমনই ভাবতাম এত দিন। ভাবতাম যে, পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে বাঙালিরা যে রামচন্দ্রের নামে পরস্পরকে সম্ভাষণ করেন না, বরং কখনও মেয়েদের আদর করে ‘এসো মা লক্ষ্মী’ বলেন, কখনও যাওয়ার সময় দুগ্গার নাম করেন, সঙ্কটে পড়লে হরির নাম করেন, ভূতের ভয় পেলে রাম-নাম জপেন, মরণকালে হরির নাম মুখে নেন— এই সব কথা নিয়ে আলোচনাও তত জরুরি নয়। বাস্তবিক, এই সব বিষয় নিয়ে লেখার কথা ভাবতেই পারতাম না কিছু দিন আগে পর্যন্ত।
বর্তমান সময়টা ঠিক ‘সাধারণ’ সময় নয়। তাই, কোনও দিন যা ভাবিনি, আজ সেটা ভাবা এবং স্পষ্ট করে বলা জরুরি হয়ে পড়েছে। এত মানুষ চার দিকে এত অর্থহীন ও মিথ্যা কথা বলছেন, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’-এর সৌজন্যে সেই সব কথার এত বড় মাপের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়ে উঠছে, প্রতি দিন এত বেশি করে ফুলেফেঁপে উঠছে চিন্তা-ভাবনা বিচার-বিবেচনার প্রতি অভব্য, অন্যায়, উদ্ধত আক্রমণ যে, বুঝতে পারছি, চুপ করে থাকার এখন একটাই অর্থ: মেনে নেওয়া।
মেনে নেওয়া যে, রাজ্য জুড়ে ও দেশ জুড়ে যা চলছে এখন, সে সবই ‘স্বাভাবিক’ ব্যাপার। মেনে নেওয়া যে, ভুল ও মিথ্যে কথা বলা হলেও আমাদের উল্টে কিছুই বলার থাকতে পারে না। এক দিকে রাজ্যপাল, সাংসদ, নেতারা বোঝাচ্ছেন ‘জয় শ্রীরাম’ হল ‘জাতীয়’ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। অন্য দিকে রোজ নিয়ম করে খবর: দেশ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় মানুষকে বেঁধে, ঘাড় ধরে টেনে, চলমান ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানো হচ্ছে— মেরেও ফেলা হচ্ছে। যারা এ সব কাজ করছে, তাদের প্রতি আমাদের নেতারা আত্যন্তিক সদয়। আর যারা বিস্ময় বা ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তাদের প্রতি নেতাদের তীব্র ভর্ৎসনা। এই আমাদের ‘সংস্কৃতি’। এই আমাদের ‘রাজনীতি’। দুই-এক বছর আগেও কান পেতে যে ‘সম্ভাষণ’ শোনা যেত না, আজ গায়ের জোরে সেটাকেই আমাদের চিরাচরিত প্রথা বলে শেখানো হচ্ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে ছেলে-ছোকরারা তেড়ে যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী ধৈর্য হারিয়ে অকথা-কুকথা বলছেন, আমাদের রাজনীতি এই নীচতায় এসে দাঁড়িয়েছে। সুশীল আলোচনায় আমরা সঙ্গত ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর নিন্দে করছি, ছি ছি, এই কি নেত্রীর মুখের ভাষা! কিন্তু চিৎকার করে বলে উঠছি না যে, ছেলেগুলির এমন একটা স্লোগান নিয়ে তেড়ে যাওয়ার সাহস কী করে হল? একটা তীব্র অশিক্ষা ও অভব্যতার পরিবেশে ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে আক্রমণের বর্বরতা। কখনও নেতা, কখনও জনতা, আমাদের ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করছেন, এত কাল কেমন ছিল আমাদের স্বাভাবিক, চিরাচরিত, দৈনন্দিন সমাজ আর রাজনীতি।
চুপ করে থাকা মানে, এই সব কিছু মেনে নেওয়া।
তাই, সহজ কথাটাই আজ খুব জোর দিয়ে বলব ঠিক করেছি— বাংলার সংস্কৃতি কী এবং কেমন, তার ধারণা বিজেপি নেতাদের নেই, আমাদের মতো ঘোষিত অ-বিজেপিদেরই আছে। কেননা, বাংলা সংস্কৃতি, ভারতের সংস্কৃতি বিষয়ে সত্যিকারের ধারণা থাকলে বিজেপি হওয়া যায় না। আপাত-গুরুত্বহীন, কিন্তু এখন-জরুরি একটি কথা তাই না বলে পারছি না। সে দিন অমর্ত্য সেন ‘নিজের বিষয়ে’ বক্তৃতা দিতেই এসেছিলেন। বক্তৃতাশেষে প্রশ্নোত্তর-পর্বেই তিনি ‘জয় শ্রীরাম’ বিষয়ক উক্তিটি করেন। এই কথা বলার অর্থ এই নয় যে, নিজে থেকে, প্রশ্ন না উঠলেও তিনি কথাটি বলতে পারতেন না। এটা মনে করানোর অর্থ, যে-কোনও বিষয়ে মতপ্রকাশের অধিকার এ দেশে সকলের আছে— এখনও পর্যন্ত— এবং অমর্ত্য সেনের মতো মানুষদের আরও বেশি করেই আছে। তাঁর মতো যে ক’জন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি, আজীবন সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতির চর্চা করা পণ্ডিত মানুষ আজও আমাদের মধ্যে আছেন, আমাদের উচিত তাঁদের কথা ধৈর্য ধরে শোনা ও বোঝা। তর্ক যদি করতে হয়, তবে সম্মান ও উপযুক্ত শিক্ষাসহকারে সেটা করা। একটা ভণ্ড অন্যায় আক্রমণসর্বস্ব রাজনীতিতে গা-ভাসানো যুক্তিহীন ইতিহাসবোধহীন দাবি আমরা মেনে নেব না।
সে দিন সংসদে মহুয়া মৈত্র তাঁর ‘বিতর্কিত’ বক্তৃতায় অনেক জরুরি কথা বলেছিলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে ঠিক ও জরুরি কথাটি ছিল: কোনও একটি স্লোগান দিয়ে ভারতের মতো দেশের ‘স্পিরিট’কে ধরা অসম্ভব। তাঁর যুক্তি অনুসারেই বলব, ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বাঙালির নয়, মুসলমানদের নয়, দলিতদের নয়, জনজাতিদের নয়— উত্তর ভারতের গোবলয়ের উচ্চবর্ণের হিন্দিভাষী সমাজের একাংশের বাইরে কারও নয়। এবং সেই সমাজেও ঐতিহ্যময় ‘জয় সিয়ারাম’ ধ্বনির থেকে ‘সিয়া’ বা সীতা অংশটি চতুর ভাবে বাদ দিয়ে যে স্লোগান তৈরি হয়েছে, উনিশশো নব্বই দশকের আগে তার আদৌ খোঁজ মিলবে না। আগে যাঁরা রামের কথা স্মরণ করতেন, শান্তিদাতা রামই থাকতেন তাঁদের মন জুড়ে— সে গাঁধীর ‘রঘুপতি রাঘব’ ধুনই ভাবি, আর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যটির কথাই ভাবি, যেখানে মৃতদেহ-বহনকারীদের নিচু গলায় মন্ত্রোচ্চারণ ‘রাম নাম সত্য হৈ’-এর মধ্যে শান্তির ধ্বনি বেজে উঠছিল। আজকের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিটি যে কতটা ইতিহাস-ভূগোল বিবর্জিত একটা আক্রমণের ধুয়ো, বুঝতে তাই অসুবিধে হয় না। মাঝখান থেকে স্লোগান ও প্রতি-স্লোগানের উন্মাদনায় কয়েক দিন ধরে সংসদের যে ছবি দেখা গেল, ভারতীয় নাগরিকের মাথা হেঁট করে দেওয়ার পক্ষে তা যথেষ্ট।
চিন্তার কথা, পরসংস্কৃতি-অসহিষ্ণু উন্মাদনা-লিপ্সু এই জনগণ ও নেতা-সাংসদদের এত অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করার ‘অধিকার’টি দিয়েছে— গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের অধিকারে মণ্ডিত হয়েই তাঁরা আজ গণতন্ত্রকে দলে-পিষে মারতে উদ্যত হয়েছেন। যে গণতন্ত্রের অর্থ ‘সকলের অধিকার’— ‘কারও কারও বেশি অধিকার’ নয়— তাকে দেশ থেকে দূর করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। হুমকি আর ধমকিকে ‘গণতান্ত্রিক’ ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ভোটের ফল বেরোনোর পরই একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলে দেখলাম, এক অধ্যাপক যেই-না বললেন, ভারত খুব দ্রুত ‘অথরিটারিয়ান’ বা কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে, অমনি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে, মাইক কেড়ে নিয়ে অ্যাঙ্কর-মশাই বললেন, এ সব কথার অর্থই হয় না— ভারত যে সফল গণতন্ত্র, একের পর এক নির্বাচন পার করতে পারার মধ্যেই তো তার প্রমাণ। সত্যিই তো। মাইক কেড়ে নিয়ে, বিরুদ্ধবাদী বক্তাকে থামিয়ে (কিংবা তাঁকে প্রাণে মেরে, জেলে ঢুকিয়ে) যেখানে গণতন্ত্রের জয় প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সে দেশে গণতন্ত্রের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠেই-বা কী করে!
গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল জয়ের পরই ঝাড়খণ্ডের সরাইকেলায় জয়ী দলের সমর্থকদের গণপিটুনিতে তবরেজ আনসারি প্রাণত্যাগ করলেন যখন— সেটাও তাই গণতন্ত্রেরই জয়! মন্ত্রী-নেতারা এই ‘বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত’ বিষয়ে মাথা ঘামালেন না। এ সব যে সম্পূর্ণত ‘ব্যতিক্রমী’, অতীব ‘বিক্ষিপ্ত’, বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধে হয় না, যখন দেখি এক মাসের মধ্যে একই ‘জয় শ্রীরাম’ পিটুনি ঘটছে সরাইকেলার পাশাপাশি অসমের বরপেটা, বিহারের গয়া, উত্তরপ্রদেশের কানপুর, মধ্যপ্রদেশের সেওনি, মহারাষ্ট্রের ঠাণে, দিল্লির রোহিণী, হরিয়ানার গুরুগ্রাম— কিংবা রাজধানী দিল্লির হৃদয়স্থল কনট প্লেসে! এই সপ্তাহেই মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়ায় বজরং দলের লোকরা পঁচিশ জনকে গরুপাচারের দায়ে বেঁধে মারধর করেছে, তাদের দিয়ে ‘গোমাতা কি জয়’ বলিয়েছে। ২০১৯-এর সাত মাসে গরু-সংক্রান্ত অাট নম্বর ‘হেট-ক্রাইম’ এটি। সত্যিই, এ আর এমন কী। ‘গণ’ যদি চায়, আমাদের চুপ করে থাকাই কর্তব্য!
এই মুহূর্তে এ দেশে যা ঘটছে, সেটাকে আমরা বলছি রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদ (অথরিটারিয়ানিজ়ম, টোটালিটারিয়ানিজ়ম) ইত্যাদি। দেখেশুনে কিন্তু মনে হয়, রাষ্ট্র এমন জায়গায় সমাজকে নিয়ে এসেছে, যেখানে রাষ্ট্রের হাত থেকে কর্তৃত্ববাদের পতাকা চলে গিয়েছে দেশজোড়া হিংসা-উন্মত্ত জনসমাজের হাতে। বিশেষজ্ঞরা যাকে বলেন ‘পপুলার সভরেনটি’, তারই বিকৃততম প্রকাশ ঘটছে। নৈরাজ্যের হুঙ্কার আর অপরাধের আস্ফালন দিয়ে গণতন্ত্রই আজ ফুঁসে উঠে গণতন্ত্রকে খেতে শুরু করেছে।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।