প্রতীকী ছবি।
চার্জশিট ১২০৩ পাতার। ১৬০ জনের সাক্ষ্য। তাদের মধ্যে বাড়ির লোকজন, হাসপাতালের কর্মী, সহকর্মীরা। তবু বাঁচানো গেল না তাঁকে। অনুসূচিত জনজাতি বা আদিবাসী বলে চিহ্নিত মহারাষ্ট্রের ভিল (তদভি) সম্প্রদায়ের মেয়েটি কত বাধা পেরিয়ে ডাক্তারি পাশ ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন, কত গর্বের সঙ্গে ডিগ্রি পাওয়ার ছবি তুলেছিলেন পরিজনের সঙ্গে। অথচ এক বছরব্যাপী মানসিক অত্যাচার, জাতিভিত্তিক বিদ্বেষ, অপমান চলাকালীন কোনও সমাধান তাঁকে দিতে পারেনি যেখানে তিনি কাজ করতেন সেই প্রতিষ্ঠান, সহকর্মী বা উচ্চতর আধিকারিকরা। সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন মাকে, স্বামীকে, প্রিয় বন্ধুকে। ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসেও পরিবারের সদস্যরা কিছু করতে পারেননি। ডক্টর পায়েল তদভি আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়ে ‘নিহত’ হন মে মাসে। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘উচ্চ’ অর্থাৎ সুবিধাভোগী বর্ণের যে তিন সহকর্মী তাঁকে নিরন্তর অপদস্থ করে চলেছেন অন্যদের সামনে, তাঁরা তাঁর পেশাগত জীবনকে সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট না করে ছাড়বেন না।
সাক্ষীদের বয়ান জানাচ্ছে, অভিযুক্তরা ডাক্তার পায়েলকে জাত তুলে কুৎসিত অপমান করতেন। গর্ভবতী ও প্রসূতিদের চিকিৎসার যোগ্যতা থাকতেও রোগীদের কাছে যেতে না দিয়ে করণিকের কাজ করানো হত। দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর মনোবল নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছিল, পেশাদারিত্বকে ছোট করা হচ্ছিল জাতীয় এন্ট্রান্সের নম্বর নিয়ে প্রশ্ন তুলে। পায়েলের মা ও পরিজনেরা মে মাসে বিভাগীয় প্রধানের কাছে অভিযোগ জানানোর পর অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। পায়েলের অপারেশন থিয়েটারে ঢোকা বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর দু’দিন আগে প্রসব-পূর্ববর্তী বিভাগ (যেখানে সাধারণত অভিজ্ঞ ডাক্তারদের নেওয়া হয়) থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর জায়গায় নেওয়া হয় তরুণতর আর এক ডাক্তারকে।
মৃত্যুর পর যেটুকু সুবিচার তদন্তের মারফত পায়েল পেয়েছেন, তার পিছনে বন্ধু স্নেহল সিজের সাক্ষ্য ও মনোবল। এই মামলায় সে প্রধান সাক্ষী। ক্রাইম ব্রাঞ্চের পেশাদারি তদন্ত। এমন কত শত মৃত্যু ও হত্যার ওপর যবনিকা পড়ে যায় প্রতি দিন।
প্রত্যন্ত জেলার ছোট গ্রামগঞ্জে নয়, এক বছর ধরে ঘটে চলা জাতিভিত্তিক নির্মমতা ও অত্যাচারের ঘটনাগুলি মুম্বইয়ের হাসপাতালের। সেই মুম্বই, যা ভারতের অন্যতম জঙ্গম মহানগর, যেখানে পিছিয়ে পড়া রাজ্য ও মহারাষ্ট্রের ছোটখাটো শহর গঞ্জ থেকে প্রতি দিন মানুষ জীবিকার সন্ধানে এসে পৌঁছন। হাসপাতালে ডাক্তার পায়েলের জায়গা হয়েছিল তাঁর অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে এক ঘরে, প্রায় দু’মাস, নিজের ঘর পাওয়া পর্যন্ত। তিন অভিযুক্ত খাটে শুতেন, ডাক্তার পায়েল মাটিতে পাতা বিছানায়। বাথরুম ব্যবহার করে বেরিয়ে অভিযুক্ত মহিলা ডাক্তাররা তাঁর বিছানায় পা মুছতেন। যে মেয়েটি তাঁদেরই মতো এক জন ডাক্তার, তাঁকে নীচে নামিয়ে শান্তি নেই, চরম নিগ্রহে পদদলিত করাটাই লক্ষ্য।
পায়েলের মৃত্যুর পর তিন অভিযুক্তই বন্ধু স্নেহলের কাছে খবর পেয়ে তাঁর ঘরে যান, দরজা বন্ধ দেখে নানাবিধ কটূক্তি, ‘ভীরুতা’র প্রতি বিদ্রুপ করতে থাকেন। ক্রাইম ব্রাঞ্চ তদন্ত না করলে পায়েলের ফোন থেকে ‘সুইসাইড নোট’টিও উদ্ধার হত না। ওই নোটে তিন অভিযুক্তকে সরাসরি দায়ী করে, এক বছরের দীর্ঘ অত্যাচারের বিবরণ রেখে গিয়েছেন পায়েল। অভিযুক্তরা তাঁর হাতে লেখা চিঠিটি নষ্ট করে ফেলেছেন। পায়েল কি জানতেন, আক্রোশ কত দূর যায়? তাই আত্মহত্যার ঠিক আগে ‘নোট’টির ছবি তুলে ফোনে রেখে গিয়েছিলেন?
২৬ বছর বয়সি ডাক্তার পায়েল তদভি প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন, নাচ ভালবাসতেন, মার্চ মাসে ফেসবুক পোস্টে রোগী-স্বজনদের নিগ্রহের প্রতিবাদে ডাকা ধর্মঘটে মুম্বইয়ের ২০০০ ডাক্তারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সহকর্মীদের কাছে প্রতিভাত হয়েছিল শুধু তাঁর জাত-গত অবস্থান, অন্য কোনও গুণ বা দক্ষতা নয়। তিন অভিযুক্তই মহিলা। লিঙ্গ-সাম্য এ ক্ষেত্রে জাত-বৈষম্যের কাছে নগণ্য হয়ে গিয়েছে। মেয়ে-পুরুষ এই পার্থক্যের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র হয়েছে বর্ণহিন্দুত্ব বনাম সংরক্ষিত জাতির পার্থক্য। যে তিন মহিলা অভিযুক্ত ডাক্তার পায়েল তদভিকে পেশাগত ভাবে ভেঙেচুরে দিতে প্রত্যহ নির্যাতন চালাচ্ছিলেন এবং যাঁরা এই সব ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে থেকেছেন, তাঁরা বিশ্বাস করেন, এবং জানেন, সংবিধান বা আইন যা-ই বলুক, জন্মগত ভাবে অর্জিত ‘উচ্চতা’র কারণে, আর্থিক ভাবে সচ্ছল, বংশানুক্রমে সুবিধার জায়গাগুলি দখল করে থাকার কারণে, তাঁরা ‘পশ্চাৎপদ’ জাতের মানুষদের ওপর প্রভুত্ব করতে থাকবেন। প্রভুত্বের চিহ্ন হিসেবে তাঁদের অপমান, নিগ্রহ ও বৈষম্যের শিকার বানাবেন, যত দিন না অপর পক্ষ জীবন বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গাটুকু ছেড়ে দিচ্ছে। অম্বেডকর লিখেছেন, এ হল হিন্দুধর্মের অন্তর্লীন বৈষম্য। শিখ ও ইসলাম ধর্মে মানুষের সহাবস্থান স্বজনচেতনা নির্মাণ করতে পারে, হিন্দু সমাজে সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে জাতপরিচয়। সেখানে আইনও অক্ষম। এ সেই দেশ, যেখানে ‘সংরক্ষণ’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পেশাদাররা ঝাঁটা হাতে বিক্ষোভ জানান— ঝাঁটাই হচ্ছে সংরক্ষিতদের একান্ত সামাজিক পরিচয়।
তথাকথিত উচ্চবর্ণের কুক্ষিগত সুযোগসুবিধার সঙ্গে ‘মেধা’কে এক করে দেওয়ার চেষ্টা চলছেই, দেশের নামী প্রতিষ্ঠানগুলিতেও। মেধার অভাবেই যে সংরক্ষিত বর্ণের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগত প্রগতি যথেষ্ট হয় না, সে কথা ঘুরেফিরে আসে। পায়েল কেন স্বামীর সঙ্গে না থেকে হস্টেলে থাকতেন, তাঁর বৈবাহিক জীবনে সুখের অভাব ছিল কি না, নিজের কাজে দক্ষ ছিলেন কি না— মৃত্যুর পরেও অভিযুক্তদের তরফ থেকে এই যুক্তিগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সমাজে দলিত ও জনজাতীয়দের ওপর ধর্ষণ, অত্যাচার ও হত্যার ঘটনায় ‘আক্রান্তকে বদনাম’ দেওয়ার পদ্ধতি সুপ্রাচীন, তাঁদের স্বভাবচরিত্র, মিথ্যা অভিযোগ করে ফাঁসানোর প্রবণতার দোহাই দিয়ে পুলিশ অভিযোগ নেয় না কত সময়।
উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই আক্রমণের পদ্ধতি অনেক বেশি প্রাতিষ্ঠানিক ও শিল্পিত— বাছারা, সংবিধানের দোহাই দিয়ে তো ঢুকেছ এখানে, কিন্তু এ জায়গাটা আমাদের! অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এমস)-এর এক কমিটির রিপোর্ট বলছে, মূল্যায়নের সময় অন্তত ৮৪ শতাংশ দলিত ছাত্রছাত্রীকে জাত সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয়েছে। ২০১৫-তে আইআইটি রুরকি ৭৩ জন ছাত্রছাত্রীকে ফল ভাল না হওয়ার জন্য বরখাস্ত করে। এঁদের তিন-চতুর্থাংশই তফসিলি জাতি ও জনজাতির। আইন অনুসারে এই সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ জানানোর জন্য একটি পোর্টাল থাকার কথা। ৮০০-র মধ্যে মাত্র ১৫৫টি প্রতিষ্ঠান পোর্টাল চালু করেছিল। গায়ের রং, ভাষা, ইংরেজি যথেষ্ট ভাল না জানার কারণে বহু দলিত জনজাতীয় ছাত্রছাত্রী জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রতি দিন বৈষম্যের শিকার হন, কিন্তু তাঁদের জন্য ইংরেজি শেখার বিশেষ ব্যবস্থা নেই। সংবিধান যেন একটা খোলা দরজা, যার ফাঁক গলে এঁরা উচ্চতর শিক্ষায় এসে পৌঁছচ্ছেন, তার পর কেবল অন্ধকার— নীরবতা, চূড়ান্ত নিস্পৃহতা, অসহযোগ, অপমান।
‘মেধা’ নিয়ে বর্ণহিন্দুদের যত মাথাব্যথা সংরক্ষিত আসনের ছাত্রছাত্রী বা পরীক্ষা উত্তীর্ণদের সম্পর্কে। যখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ‘মেধা’তালিকায় কম নম্বর পেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি হয়, তাদের নিম্নমেধা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না, যে হেতু অর্থের জোর পিছনে আছে।
তফসিলি জাতি ও জনজাতীয়দের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ঘোষিত অপরাধের সমান্তরালে বয়ে চলেছে বৈষম্য, অপমান ও নিগ্রহের স্রোত, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনসমক্ষে আসে না। অম্বেডকর যে অপমান ও নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন তাঁর কর্মজীবনে, রোহিত ভেমুলা বা পায়েল তদভির জীবনেও তা আগ্রাসন হয়ে উপস্থিত হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান, অপরাধ-রোধ আইন কি তবে সমাজের মানসিক অবস্থানের ওপর কোনও প্রভাব ফেলেনি, রয়েছে একটি খড়ের কাঠামো হয়ে?
কিছু দিন আগে দিল্লির এক স্তব্ধ প্রেক্ষাগৃহে ‘আর্টিক্ল ফিফটিন’ ছায়াছবিটি শেষ হলে আমরা বলাবলি করছিলাম, উত্তরপ্রদেশে ছবিটি তৈরি হয়েছে, মুক্তি পেয়েছে কোনও বৃহৎ বাধা ছাড়াই! ভাবা যায় না। ছবিটির নায়ক ও ত্রাতা হিসেবে দেখানো হয়েছে এক ব্রাহ্মণ পুলিশ অফিসারকে, তা সত্ত্বেও বলব, ছবিটি বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে মূলধারার আলোচনায় এনেছে। হলের স্তব্ধতা তারই এক সূচক। এখন মনে হচ্ছে, ছবিটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি প্রয়োজন বলেই মনে করেননি সুবিধাভোগী বর্ণহিন্দু সমাজ, কারণ তাঁদের কাছে ছবিটির বক্তব্য সম্পূর্ণ মূল্যহীন। তাঁরা যা চান, তা-ই চলতে থাকবে, এ ছবির মুক্তি বা সাফল্যে কিছু আসে যায় না।