করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে চলা ‘লকডাউন’-এ বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কোনও-না-কোনও ভাবে প্রভাবিত হয়েছে। আপনি এটাকে কী ভাবে দেখেন? পড়ুয়াদের উদ্বেগের ঠিক কেমন ছবি কী ভাবে উঠে আসছে?
—যখন চিন থেকে করোনা অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তখনও আমাদের দেশের সরকার গভীর ঘুমে! ২০২০-এর মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে এসে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হঠাৎ ঘুম ভাঙে। তিনি করোনা সংক্রমণ রুখতে প্রথমে ঘোষণা করেন ‘জনতা কারফিউ’। তার পর সেই দিনই রাত আটটায় ‘ঐতিহাসিক’ টেলিভিশন ভাষণে আগামী তিন সপ্তাহের সর্বাত্মক ‘লকডাউন’ জারি করেন! করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে ঘরের চৌকাঠের মধ্যেই থাকার নিদান দিলেন দেশবাসীর জন্য। কোনও রকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই, মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে বন্ধ হয়ে গেল সমস্ত যানবাহন চলাচল, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, দেবালয়...সব সব কিছু।
সেই থেকে অন্য সবার মতোই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও ঘরবন্দি। বন্ধ হয়েছে স্কুল-কলেজে যাওয়া, বন্ধ হয়েছে খেলার মাঠে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করাও তো বন্ধ! চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে গেল তাদের জগৎ। বাইরের সঙ্গে যোগসূত্র হিসেবে থাকল শুধু খবরের কাগজ, টেলিভিশন, কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন। টেলিভিশন, খবরের কাগজ আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আসতে লাগল করোনা ভাইরাস সংক্রমণের নতুন নতুন খবর। অনেকের মতোই পড়ুয়াদের মনেও দেখা দিতে শুরু করল নানা রকম অনিশ্চয়তা, অজানা আশঙ্কা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
যখন আমরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় থাকি, তখন আমাদের শরীরের মধ্যে কিছু অসুবিধা দেখা দেয়। বুক ধড়ফড় করা, হাত-পা কাঁপা কিংবা ঠান্ডা হয়ে আসা, ঘামতে থাকা, ঘাড়ে কিংবা পিঠে ব্যথা, মাথাঘোরা বা মাথায় যন্ত্রণা, কান গরম হয়ে যাওয়া, পেটের মধ্যে অস্বস্তি, গা গোলানো বা বমি হওয়া। মনের মধ্যে অস্থিরতা, কোনও কিছুতে মনঃসংযোগ করতে না-পারা, অজানা আশঙ্কা ও ভয়, অনেক দূরের কোনও নেতিবাচক পরিণতি ভেবে নিয়ে কাতর হওয়া। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আক্রান্তদের মধ্যে এই মানসিক লক্ষণগুলোও অনেকের মধ্যেই তীব্র আকার নেয়। অনেকের মধ্যেই চোখে পড়েছে--- করোনা ভাইরাসে নিজে আক্রান্ত হওয়ার ভয়, কাছের মানুষদের জন্য দুঃশ্চিন্তা, পড়াশোনা নিয়ে-পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা, খেলাধুলা বন্ধ হওয়া নিয়ে মনখারাপ, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না-হওয়ার জন্য অস্থিরতা। এ সবের পাশাপাশি কারোর কারোর মধ্যে দেখা দিল, তীব্র মনখারাপ, বিরক্তি আর রাগের প্রকাশ! তার ছাপ পড়ল কাছের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কের উপরেও।
মানসিক এই অসুবিধাগুলোর মোকাবিলা কী ভাবে করা যেতে পারে?
—স্নান-খাওয়া-ঘুম নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে যদি করা যায়, পর্যাপ্ত পরিমাণে জল যদি খাওয়া যায়, নিয়ম করে প্রতিদিন যদি একটু ঘাম-ঝরানো এক্সারসাইজ করা যায়, গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম করা যায়---তা হলে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মাত্রা একটু কমে আসে। এর সঙ্গে মনের কথা মনের মধ্যে জমিয়ে না-রেখে ভরসা-করা-যায়, এমন কারোর কাছে বলতে পারলেও হালকা হয় মন। এর পাশাপাশি ‘হোয়াটস্অ্যাপ ইউনিভার্সিটি’র তথ্যের উপরে নির্ভর না-করে, ভরসা থাকুক বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য আর পরামর্শের উপর। তাতে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা একটু কমে। আর, উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মাত্রা যদি খুব বেশি হয়, মন খারাপের মাত্রা যদি তীব্র হয়, অনেক দিন ধরে চলতে থাকে, তার প্রভাব পড়তে শুরু করে খাওয়া এবং ঘুমের উপর, নেতিবাচক চিন্তায় যদি ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে মন, তখন অবশ্যই কোনও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
আসলে আমরা দেখলাম, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ‘লকডাউন’ পর্বে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বাড়ল ইন্টারনেট-নির্ভরতা। কখনও তা পড়াশোনার কারণে, কখনও আবার তা ‘অনলাইন গেমস্', ইউটিউব, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-নির্ভরতায়। কিছু দিন পরে নিদান এল, অনলাইন ক্লাসের! সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে, ৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ২৪ বছরের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া--- সবার জন্যই ‘অনলাইন’ পড়াশোনার নিদান! একবারও ভেবে দেখা হল না, আমাদের দেশে কত শতাংশ পরিবারে অনলাইন ক্লাস করার উপযুক্ত স্মার্টফোন আছে? তথ্য বলছে, সাকুল্যে ৩০ শতাংশ পরিবারে থাকতে পারে স্মার্টফোন! পরিবারে থাকলেই যে ছাত্রছাত্রীর পক্ষে তা আদৌ ব্যবহার করা সম্ভব কিনা তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করলেন না শিক্ষক-শিক্ষিকা কিংবা নীতিনির্ধারকরা।
তা হলে পরিকল্পনার গলদও অন্যতম কারণ?
তাঁরা কী একবারও ভেবে দেখেছেন, ক’জন শিক্ষক-শিক্ষিকার পক্ষেই বা সম্ভব শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনার সিলেবাসকে রাতারাতি ‘অনলাইন ক্লাস’-এ পরিবর্তিত করতে পারেন? আমাদের রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলা সম্প্রতি সাইক্লোনের ফলে প্রবলভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। এমনিতেই গ্রামাঞ্চলে বহু জায়গায় ইন্টারনেটের সংযোগ তেমন থাকে না। থাকলেও তা ওঠানামা করে। আর, এই সাইক্লোনের পরে চূড়ান্ত বিপর্যস্ত হয়েছে ইন্টারনেট-পরিষেবা। কিন্তু, তার পরেও বহু জায়গায় ছাত্রছাত্রীদের উপরে চাপ তৈরি করা হয়েছে অনলাইন ক্লাস বা ‘অ্যাসাইনমেন্ট’-এর জন্য। ছাত্রছাত্রীদের পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্মম উদাসীনতা ছাড়া এই অনলাইন পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো না শিক্ষকশিক্ষিকা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। বহু ছাত্রছাত্রীকে বঞ্চিত করে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন। বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা, যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন এই অনলাইন পাঠে ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশের বঞ্চনা নিয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলতে পেরেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও স্তরের একজন ছাত্র বা ছাত্রীর কাছেও যদি এই সুযোগ না থাকে, আমি অনলাইন শিক্ষার বিরুদ্ধে! যে দেশে শিক্ষা পরিকাঠামোতে নেই প্রয়োজন মতো শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ, অভাব রয়েছে পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার, বইপত্র পৌঁছতে কয়েক মাস পেরিয়ে যায়..সেখানে অনলাইন শিক্ষা শেষ পর্যন্ত প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য।
কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্টফোনের উপযোগিতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। পুরো পৃথিবীটাকেই হাতের মুঠোর মধ্যে এনে দিয়েছে। সহজ করে দিয়েছে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ। এগুলোর সদ্ব্যবহারের যেমন অমিত সম্ভাবনা আছে। তেমনই আছে মাদকের মতোই অতিনির্ভরতার আশঙ্কা। অপব্যবহারের হাতছানি। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যাদের সুযোগ রয়েছে ইন্টারনেট সুবিধা-যুক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের, তাদের অনেকের মধ্যেই বাড়ছে মনঃসংযোগের সমস্যা। পড়াশোনার প্রতি অবহেলা। স্মার্টফোনের ডিজিটাল স্ক্রিনের প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে এই লকডাউন পর্বে। দীর্ঘক্ষণ ধরে ডিজিটাল স্ক্রিনে চলন্ত জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ফলে সাদা কাগজের উপরে কালো অক্ষরে ছাপা স্থির হরফের ওপর চোখ রাখতে গেলে সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া এই কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে মাদকের মতোই মানসিক-নির্ভরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ-বিষয়ে সচেতনতা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এখনও খুব কম। আমি সত্যিই এই প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করছি, না অপব্যবহার? এই প্রশ্ন নিজেকে করার অভ্যাস আমাদের প্রত্যেকের জন্যই জরুরি।
শেষে আর একটা কথা বলা জরুরি। লকডাউন যখন উঠতে চলেছে, একে একে সব কিছু যখন খুলতে শুরু করেছে। আনলক- ১ ঘোষিত হয়েছে। ঠিক সেই সময়ে, যখন আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ এবং সেই সংক্রমণে মৃত্যুর পরিসংখ্যান সর্বোচ্চ পর্যায়ে। লকডাউন যেমন সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত ছিল। আন-লক প্রক্রিয়াতেও কোনও পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই সংক্রমণে মৃত্যুর শতকরা হার হয়তো অনেক কম। আক্রান্তের মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ হয়তো প্রাণ হারাবেন। কিন্তু, আক্রান্তের সংখ্যা যদি খুব বেশি হয়, তাহলে মৃত্যুর সংখ্যাও স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।
সুতরাং, সতর্কতার কোনও বিকল্প নেই। এখনই না হোক। আর কিছু দিন পরে খুলতে শুরু করবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। ঘর ছেড়ে বেরোতেই হবে বাইরে। কিন্তু, বেরোনোর সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা দেশের ও রাজ্যের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতো পর্যাপ্ত সতর্কতা নিয়ে চলাফেরার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে আমাদের সবাইকেই, ছাত্রছাত্রীদেরও অবশ্যই।