Murshidabad

সেই সব হারানো মুখগুলি এক বার ফিরে দেখা

তাঁদের কথা আর তেমন মনে পড়ে না, অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ায় নেপথ্যে তাঁরাও কি ছিলেন না, প্রশ্ন তুললেন স্বাতী চট্টোপাধ্যায় তাঁদের কথা আর তেমন মনে পড়ে না, অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ায় নেপথ্যে তাঁরাও কি ছিলেন না, প্রশ্ন তুললেন স্বাতী চট্টোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৫
Share:

নিরুপমা দেবী (বাঁ দিকে) ও রানি স্বর্ণময়ী।

সামনেই প্রজাতন্ত্র দিবস। ফুল মালা ফ্ল্যাগ ফেস্টুন— তৈরি। এ দেশ প্রজাতন্ত্রের স্বাদ পাওয়ার নেপথ্যে রয়ে গিয়েছে এই তাঁরা যাঁদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া দেশের শৃঙ্খলমোচন বোধহয় সম্পূর্ণ হত না। তাঁদের মনে রাখাও আর তেমন গুরুত্ব পায় না। তবু এক বার ফিরে দেকা যাক।

Advertisement

দেশ জুড়ে এখন বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, কন্যাশ্রী প্রভৃতি প্রকল্পের মাধ্যমে কন্যাসন্তানের মর্যাদাবৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত, ঠিক সেই সময়েই রক্ষণশীলতার বেড়াজালে আবদ্ধ এই অন্তঃপুরবাসিদের সাহস ও তেজস্বীতার প্রতি কুর্নিশ জানানো বোধহয় জেলার মানুষের অবশ্য কর্তব্য বলে মনে হয়।

এই বীরাঙ্গনাদের মনের কোনে সযত্নে লালিত স্বাধীনতাস্পৃহা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের সুপ্তবাসনা ১৯২০-র দশকের আগে প্রকাশিত হওয়ার বিশেষ সুযোগ পায়নি। যদিও নারী জাগরণের সলতে পাকানোর কাজটি এই জেলায় শুরু হয়েছিল উনিশ শতক থেকেই। শিক্ষাই যে নারীদের স্বাভিমান এবং আত্মপরিচয়ের প্রধান মাপকাঠি সে কথা উপলব্ধি করে কাশিমবাজারের তরুণ মহারাজা কৃষ্ণনাথ এবং তাঁর সহধর্মিণী মহারাণী স্বর্ণময়ী একাধিক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুগান্তকারী আন্দোলনকে রাজবাড়ির অন্দরমহল থেকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেছিলেন স্বর্ণময়ী। এ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন কোন বিশেষণই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট নয়। অন্য দিকে সমাজে পর্দা-প্রথার অবসান এবং লিঙ্গ-সাম্যের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন হরিহরপাড়া থানার চোঁয়াগ্রামের কৃষ্ণভাবিনী দাস এবং সালারের সাহাপুর গ্রামে নুরুন্নেসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী।

Advertisement

শিক্ষা ও প্রগতিশীল চিন্তার হাত ধরে স্বাধীনতার অপরিহার্যতার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার মহিলারা। তদুপরি আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, মহাত্মা গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের স্বাধীনতা আন্দোলনে মাতৃজাতিকে অংশগ্রহণের আন্তরিক আহ্বান অনেকটা অনুঘটকের মত কাজ করেছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ডাকে সাড়া দিয়ে কান্দির জেমো অঞ্চলে স্থানীয় মহিলাবৃন্দ পালন করেছিলেন অরন্ধন। আবার ১৯০৬ সালে আচার্যের মাতা চন্দ্রকামিনী দেবীর আমন্ত্রণে আহুত প্রায় পাঁচশত পুররমণীর সম্মুখে রামেন্দ্রসুন্দর রচিত ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’ পাঠ করে শুনিয়েছিলেন তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা গিরিজাদেবী। এই ব্রতকথার ছত্রেছত্রে বর্ণিত স্বদেশবন্দনা অনুপ্রাণিত করেছিল নারীজাতিকে। স্বাধীনতার মরণপণ লড়াই এ পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে তেজিস্বনীরা এই জেলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁরা অনেকেই স্থান পাননি ইতিহাসের পাতায়। পারিবারিক রাজনৈতিক আবহ এবং পরিজনদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্রয়ে যে স্বল্পসংখ্যক নারীসংগ্রামী রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরোভাগে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাদের মধ্যে মৃণালদেবী, মণিমালা দেবী, কালিদাসী সান্যাল, সুবর্ণলতা ভট্ট, নিরুপমা দেবী, চুন্নুকুমারী পাণ্ডে, সবিতা গুপ্ত, শৈলবালা মল্লিক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এ ছাড়াও কিরণ দুগড়, জ্যোতির্ময়ী বাগচী, উমা রায়, মাধবী সেন, শান্তি সরকারের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণীয়।

জঙ্গিপুর আদালতের আইনজীবী শিবচন্দ্র রায়ের পঞ্চকন্যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মণিমালা ও মৃণালদেবী। বালুচর কংগ্রেসের সভাপতি ডা. সুকুমার অধিকারীর ভাই সুনীল অধিকারীর সঙ্গে বিবাহ হয় মণিমালা দেবীর। ফলে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সংস্পর্শে তিনি নিজেও হয়ে ওঠেন রাজনীতিমনস্ক, এক জন দেশপ্রেমিক।

মণিমালা দেবীর সহোদরা মৃণালদেবী পরিণয়বন্ধনে আবদ্ধ হন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঘাযতীনের মামাতো ভাই ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই দুই বোনই কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে যোগ দেওয়ার এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের বক্তৃতা শোনার সুযোগলাভ করেছিলেন।

১৯২৯ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ৬৩ দিন অনশনের পর বিপ্লবী যতীন দাস মৃত্যুবরণ করেন। সারাদেশে এই ঘটনার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। অস্থির হয়ে ওঠেন সুভাষচন্দ্র, বিচলিত হন রবীন্দ্রনাথ। ১৫ই সেপ্টেম্বর বহরমপুরে জেলা কংগ্রেস কমিটির ডাকে ছাত্র ও যুবকদের একটি মিছিল শহর পরিক্রমা করে। ওইদিন সন্ধ্যাবেলা গ্রান্ট হলে একটি প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ প্রতিরোধের উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল তাকে প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে গাঁধী অনশন বা আত্মদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অনশনে ব্রতী হয়েছিলেন মৃণালদেবী। এই অনশন চলেছিল প্রায় মাসাধিককাল। ১৯২৯ এর ২৮শে সেপ্টেম্বর দৈনিক বঙ্গবাণী পত্রিকায় ‘অনশনব্রতে মহিলা’ শিরোনামে ঘটনাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত ভারতবর্ষে মৃণালদেবীই প্রথম মহিলা রাজনৈতিক কর্মী যিনি এত দীর্ঘদিন অনশন করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র তাঁকে অনশন প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন কিন্তু মৃণালদেবী নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। লাহোর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর কাছেও পৌঁছেছিল এই অসমসাহসী নারীর অনশনের সংবাদ। তিনি মৃণালদেবীর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। অল্প কিছু দিন পরে উভয়ের সাক্ষাতের সুযোগ উপস্থিত হয় কিছুটা আকস্মিক ভাবেই। কংগ্রেসের একটি অধিবেশন উপলক্ষে লাহোরে উপস্থিত হয়ে মৃণাল দেবী জেলে গিয়ে দেখা করেন ভগৎ সিং-এর সঙ্গে। ভগৎ সি তাঁকে একটি কলম উপহার দেন, যা তিনি আজীবন অমূল্য স্মৃতি হিসাবে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন।

১৯২৯ সাল নাগাদ নির্দিষ্ট সাংগিঠনিক দায়িত্ব নিয়ে মুর্শিদাবাদে আসেন তিনি। কাউন্সিল নির্বাচনে উপলক্ষে ওই সময়ই জিয়াগঞ্জে আগমন ঘটে সুভাষচন্দ্র বসুর। ১৯৩০ এর ২৬শে জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করার জন্য জেলার সর্বত্র পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। নানা স্থানে সভা, সমাবেশ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। জিয়াগঞ্জে এই উদ্দেশ্যে আয়োজিত ঐতিহাসিক মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন মৃণালদেবী, মণিমালা অধিকারী, চুন্নুকুমারী পাণ্ডে, কিরণ দুগড় প্রমুখ নারী সংগ্রামীরা। মিছিল বারোযারিতলায় পৌঁছতেই পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জের ফলে মৃণালদেবী সহ আরও অনেকে আহত হন। গ্রেফতার করা হয় মৃণালদেবীকে। তাঁর ছ’মাস কারাদণ্ড হয়। এই সময়ে স্বামীর মৃত্যুও তাঁকে করে তোলে ব্যাথিত শোকভারে ভারাক্রান্ত।

কিন্তু ‘চরৈবেতি’ যাদের জীবনের মূলমন্ত্র তাদের গতিরোধ করা অসম্ভব। ১৯৩০ এর মাঝামাঝি সময়ে মুর্শিদাবাদ জেলায় গড়ে ওঠে মহিলা রাষ্ট্রীয় সমিতি। এর সভানেত্রী নির্বাচিত হন মৃণালদেবী। সহসভানেত্রী হন সুবর্ণলতা ভট্ট, উমা রায়, ষোড়শীবালা দেবী প্রমুখরা। কার্যনির্বাহী সমিতির সদস্যা ছিলেন কালিদাসী সান্যাল, আশাদেবী, রাজরাণী দেবী প্রমুখগণ। ১৯৩২ সালের আইনঅমান্য আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সমিতি।

বহরমপুরের ষোড়শীবালা দেবী এবং তাঁর কন্যা জ্যোতির্ময়ী দেবী, ললিত বাগচীর কন্যা বেবি বাগচী, রেণুরেখা রাহা প্রমুখ বীরাঙ্গানারা প্রবীণ নেত্রী কালিদাসী সান্যাল, সুবর্ণলতা ভট্ট, মৃণালদেবীদের নেতৃত্বে আইনঅমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেপ্তারবরণ করেন। নারীদের সুনিপুণ নেতৃত্ব যেন এটিই প্রমাণ করে যে ঘরকন্নার বাইরেও তাদের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

শিক্ষিকা, কান্দি রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র গার্লস হাইস্কুল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement