নাথুরাম গডসেকে ‘দেশভক্ত’ বলে হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা এই প্রথম ঝামেলায় পড়লেন না। ১৯৬৪ সালে নাথুরামের ভাই এবং গাঁধী-হত্যার চক্রান্তের শরিক গোপাল গডসে যখন কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ করে ছাড়া পেলেন, তখন পুণেতে তাঁকে সংবর্ধনা দিতে এক সভা ডাকা হয়। সেখানে তরুণ ভারত পত্রিকার সম্পাদক ডি ভি কেতকর— তিনি কেশরী পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক ও বালগঙ্গাধর টিলকের নাতি— নাথুরাম গডসেকে ‘দেশভক্ত’ই বলেছিলেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আরও রিপোর্ট করেছিল যে, ‘‘কেতকর এর সঙ্গে আরও যোগ করেন যে, তিনি জানতেন ওরা গাঁধীজিকে মারবে। শুনেই গোপাল গডসে তাঁকে বলেন, এই বিষয়ে আর ‘বেশি না বলতে’। কিন্তু কেতকর বলেন, ‘এখন এর জন্য ওরা আমাকে গ্রেফতার করবে না।’ (দ্রষ্টব্য: কপূর কমিশন রিপোর্ট, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬২)।
প্রসঙ্গত, ওই সংবর্ধনাসভার আমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল: ‘‘দেশভক্ত প্রয়াত নাথুরাম ভি গডসের ভাই শ্রীগোপালরাও গডসে, এবং শ্রীবিষ্ণুপন্থ করকরে ও শ্রীমদনলাল পওয়া-র কারামুক্তির আনন্দ উদ্যাপনে, আমরা শ্রীসত্যবিনায়কের পূজা করার জন্য ও তাঁদের অভিনন্দন জানানোর জন্য তাঁদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’’ নাথুরাম গডসের সহ-ষড়যন্ত্রীকে সম্মান জানাতে এই সভায় প্রায় ২০০ জন আসেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর প্রতিবেদন ঘিরে তৎকালীন বম্বে বিধানসভায় এবং সংসদে বহু প্রশ্ন ওঠে, কেতকর গ্রেফতার হন। শেষে একটি তদন্ত কমিশন বসানো হয় জানার জন্য যে, গাঁধীহত্যার পিছনে আরও বৃহত্তর ‘চক্রান্ত’ ছিল কি না, ও তৎকালীন সরকার গাঁধীকে বাঁচানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল কি না।
এই কমিশন একশোর ওপর সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলে, এবং তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্পেশাল পুলিশ ও গোয়েন্দা দফতরের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার বিপুল অক্ষমতার কথা জানা যায়। সরকারি ক্ষমতায় আসীন বড় মাপের নেতারা গাঁধী-হত্যার চক্রান্তের কথা জানতেন কি না, এই নির্দিষ্ট প্রশ্নে রিপোর্ট সরকারকে দায়মুক্ত সাব্যস্ত করে। তবে অনুসন্ধান থেকে যে সামগ্রিক ছবিটা ফুটে ওঠে, তা বোঝায়, গাঁধী ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল, বিশেষত মহারাষ্ট্রে, কেশরী-র সঙ্গে সংযোগ ছিল যাদের সেই মহলে। তারা নাথুরাম গডসে ও তাঁর সাগরেদদের বেশ সম্মানের চোখেই দেখে চলেছিল।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
প্রজ্ঞা ঠাকুর নাথুরাম গডসেকে ‘দেশভক্ত’ বলেছেন বলে উদারপন্থীদের ক্রোধ স্বাভাবিক। কিন্তু তার সঙ্গে হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা গডসে ও গাঁধীকে নিয়ে ঠিক কী ভাবেন, সে সব জানার চেষ্টাও দরকার।
শিমলা হাইকোর্টে গডসের মামলা নিয়ে বিচারপতি জি ডি খোসলার প্রবন্ধ থেকে একটি অংশ প্রায়ই উদ্ধৃত হয়। গডসে যখন আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতাটি শেষ করেন, আদালত-কক্ষ স্তব্ধ হয়ে যায়। মহিলারা কাঁদতে শুরু করেন, পুরুষরা অস্বস্তিতে গলাখাঁকারি দেন। বিশেষ আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনেছিলেন যে তিন বিচারপতি, খোসলা তাঁদের অন্যতম। ওই প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘‘সে দিন আদালতে সমবেত দর্শকদের নিয়ে যদি জুরি গঠন করা হত ও গডসের আপিল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দেওয়া হত, বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গডসে নির্দোষ সাব্যস্ত হতেন।’’
ভারতের অন্য প্রান্তে, কলকাতার লোরেটো কলেজে সেই সময় পাঠরত, ভবিষ্যৎ বিচারক লীলা শেঠ তাঁর স্মৃতিচারণে সেই দিনের কথা বলেছেন, যে দিন কলেজের সন্ন্যাসিনীরা তাঁকে জানান যে, প্রার্থনাসভায় মহাত্মাকে গুলি করা হয়েছে। লিখেছেন তিনি, ‘‘একটা ঘরে দল বেঁধে জড়োসড়ো হয়ে ফিসফিস করে কথা বলছিলাম, আমাদের হৃদয় তখন গভীর বেদনায় ভারাক্রান্ত। নেহরুর সেই স্মরণীয় মন্তব্যের ভাষায় বললে, আমাদের সবার জীবন থেকেই আলো চলে গিয়েছিল। ভয় ও অন্ধকারের একটা ঠান্ডা শিহরনের সঙ্গে আমরা অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম, খুনি কে হতে পারে। আমার এক মহারাষ্ট্রীয় সহপাঠী প্রচণ্ড ক্রোধে বলল, ‘নিশ্চয়ই কোনও শয়তান মুসলমান এই কাজ করেছে। ওদের বিশ্বাস করা যায় না।’ দেখা গেল, খুনি এক জন মহারাষ্ট্রীয় হিন্দু, নাথুরাম গডসে।’’
দিল্লিতে যখন বিরাট অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে, সেই সময় হিন্দু মহাসভার কিছু নেতা-সহ মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণদের বাড়ি আক্রান্ত হয়। হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দফতর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, কারণ গডসে ওই দু’টি সংগঠনের অনুগামী ছিলেন। গাঁধী হত্যার উদ্দেশ্যে দিল্লি যাওয়ার পথে যে যে শহরে নাথুরাম গডসে থেকেছিলেন, সেখানে শুরু হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। শ’য়ে শ’য়ে মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। কিছু বাড়িতে গাঁধীর মৃত্যু উদ্যাপনের খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করা হয়, এও মনে রাখতে হবে। আসলে, এ দেশে গডসে বা প্রজ্ঞা ঠাকুরের মতো লোকেদের প্রতি একটা গোষ্ঠীর সমর্থন চিরকালই আছে।
স্বাধীনতা তথা দেশভাগের এক সপ্তাহ আগে অমৃতসরে গাঁধীকে কালো পতাকা-সহ বিক্ষোভ দেখানো হয়, গলায় কালো মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। গাঁধীর ব্যক্তিগত সহায়ক প্যারেলাল বলেছেন, গাঁধী হত্যার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই দিল্লির বিড়লা হাউসের বাইরে তিনি ‘গাঁধী মুর্দাবাদ’ ধ্বনি শুনতে পেতেন। গাঁধী কোনও দিনই উগ্র সমালোচনায় অনভ্যস্ত ছিলেন না, প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিতর্কেও তিনি কখনও পিছপা হননি, বিশেষত জীবনের শেষ পর্বে। কিন্তু সংঘর্ষের পথ তাঁর পথ ছিল না। তিনি প্রতিপক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ করে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝানোর চেষ্টা করতেন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে একটি আরএসএস ক্যাম্পেও গিয়েছিলেন, সঙ্ঘের প্রধান এম এস গোলওয়ালকরের কাছে আরএসএস-এর হিংসার বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন। সঙ্ঘের মুখপত্র দ্য অরগানাইজ়ার তাদের ১৮ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭) সংখ্যায় একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘‘কিছু দিন আগে গাঁধীজি সঙ্ঘের গুরুজির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সঙ্ঘের বিরুদ্ধে কলকাতা আর দিল্লি থেকে পাওয়া কিছু অভিযোগের কথা তাঁকে জানান। গুরুজি তাঁকে আশ্বাস দেন যে, সঙ্ঘের প্রত্যেকটি সদস্যের যথাযথ আচরণের নিশ্চয়তা না দিতে পারলেও এটুকু বলতে পারেন যে, সঙ্ঘের নীতি কারও ক্ষতি করা নয়, কেবল হিন্দু ও হিন্দুত্বের সেবা।
নাথুরাম গডসের সঙ্গে আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার যোগাযোগ অনস্বীকার্য, যদিও তা বার বার অস্বীকারের চেষ্টা হয়েছে। গাঁধী হত্যার সঙ্গে হিন্দু মহাসভার সম্পর্কই ১৯৫০-এর দশকে জনসঙ্ঘের সঙ্গে তাদের মিলনের সম্ভাবনা বানচাল করে দেয়। ১৯৯৩ সালে আডবাণী নাথুরাম গডসের প্রশংসা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার পর গোপাল গডসের বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনলে শ্রীমতী গডসে বিবিসিকে বলেন, বিজেপির প্রেসিডেন্ট আডবাণী নাথুরাম গডসের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করতেই পারেন, ‘‘কিন্তু তা বলে এই মিথ্যা দাবি তিনি করছেন কেন যে, নাথুরাম আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না? নাথুরাম (আমার ভাশুর) আরএসএস-এর বৌদ্ধিক প্রচারক ছিলেন, পুণে ও সাংলিতে আরএসএস-এর শাখা বিস্তারের কাজে প্রত্যক্ষ যুক্ত ছিলেন। এই সম্পর্ক অস্বীকার করে আডবাণী কী প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন?’’
গডসের সমর্থকদের একটি অংশ বরাবরই গডসে-জয়ন্তীর দিনে অখণ্ড ভারতের প্রতি আনুগত্যের কথা ঘোষণা করে এসেছেন। কিন্তু একটি ছোট বৃত্তের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকত, এ কথাটা জেনেই যে, অধিকাংশ ভারতবাসীর দৃষ্টিতে তাদের এই ভাবনা ছিল ভয়ানক অনাচারের তুল্য।
একই সঙ্গে, হিন্দু দক্ষিণপন্থার মূলধারার অনুগামীরা গাঁধীকে আত্মসাৎ করতে চেষ্টা চালান। জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার কাল থেকে এ রকম একটা প্রয়াস দেখা যায়। গাঁধীকে ‘বীর’ আখ্যা দেওয়া হয় এবং তাঁর ১৯২০’র দশকের কিছু লেখার বাছাই-করা অংশ তুলে নিয়ে তাঁকে এক জন হিন্দু সাধু বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়। বলা হয়, তিনি এক জন সাহসী হিন্দু, যিনি নানা বিষয়ে হিন্দুস্বার্থ রক্ষার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল গো-রক্ষার সমর্থনে গাঁধীর অবস্থানের, যে গো-রক্ষা হিন্দু দক্ষিণপন্থার কাছে চিরকালই অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। এই জন্যই মোদী বলতে পারেন যে, বাপুকে অপমান করার জন্য তিনি কোনও দিন প্রজ্ঞা ঠাকুরকে ক্ষমা করবেন না। হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা গাঁধীকে তাঁর সমস্ত জটিলতা ও স্ববিরোধিতা থেকে মুক্ত করে নিজেদের সুবিধেমতো একটা একমাত্রিক রূপ দেন।
১৯৭৯ সালে গোপাল গডসে হিন্দু মহাসভার অফিস সচিব হিসেবে ঘোষণা করেন যে তিনি দিল্লির লোকসভা আসনে নির্বাচন লড়বেন। ঘোষণাটি করেন বিক্রম সাভারকর, বীর দামোদর সাভারকরের ভাইপো। সেই উদ্যোগ যে সফল হয়নি তা সবারই জানা। কিন্তু আজ প্রজ্ঞা ঠাকুরের বেলায় কী হবে?
গডসে-ভক্তদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটি প্রধানমন্ত্রী মোদীর জমানায় আয়তনে অনেক বেড়েছে। ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় গোপাল গডসে কেতকরকে বলেন, গাঁধী-হত্যা নিয়ে বেশি কিছু না বলাই ভাল। একটি ব্যক্তিগত আমন্ত্রণের লিপিতে নাথুরাম গডসেকে দেশভক্ত বলা নিয়ে ভারতীয় সংসদ তোলপাড় হয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ বলেন, এ এক ‘কুৎসিত মানসিকতার বীভৎস প্রকাশ: প্রায় উন্মাদনার শামিল’। উত্তরপ্রদেশের (তখন নির্দল) সাংসদ চন্দ্রশেখর বলেন, এই সংবর্ধনা সভা ‘হিংসা ও রাজনৈতিক হত্যা’কে উৎসাহ দেয়।
আর আজ? প্রজ্ঞা ঠাকুর দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সাংসদ। গডসেকে প্রকাশ্যেই দেশভক্ত বলতে পারেন, বড়সড় জনসমর্থনও তিনি পেতে পারেন। সন্ত্রাসবাদ মূলধারায় পরিণত হলে এই রকমই হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক
ছবি: গেটি ইমেজেস