যাহা যায় আর যাহা কিছু থাকে

সবই জেগে রয়!

কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিজেপিকে হারানোর জন্য একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার সাধারণ সূত্র কার্যত আধপাকা হয়েই রইল।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৯ ০০:১৭
Share:

স্থির-লক্ষ্য: মালদহের চাঁচলে দলীয় নেতাদের সঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী। ২৩ মার্চ, ২০১৯। পিটিআই

অতঃ কিম্‌! দেশে ভোটগ্রহণ পর্ব শুরু হওয়ার দু’সপ্তাহ আগে ভাবনাটি খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ বিরোধী জোটের আঁটসাঁট অবয়ব এখনও চোখের সামনে খুব স্পষ্ট হয়নি। তার উপর এই রাজ্যে তাঁর প্রথম নির্বাচনী সভায় দেশের শাসক মোদী এবং বিরোধী নেত্রী মমতাকে এক বন্ধনীতে তুলে এনে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী যে বার্তা দিয়ে গেলেন, তার পরে জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক কোথায় গড়াবে এবং সামগ্রিক ভাবে বিরোধীদের জোট-রাজনীতিতে তার কতটা কী প্রভাব পড়বে, সেই সব নিয়েও এ বার মানুষ আলোচনা শুরু করেছেন। উঠছে নানা প্রশ্ন।

Advertisement

বিজেপিকে পরাস্ত করে নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে দেশ জুড়ে জোট-রাজনীতির সূচনা হয়েছিল। মোদীকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রশ্নে প্রায় সকল বিরোধী দল একসঙ্গে হাতে হাত ধরে কাজে নেমেছিল। সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রথম থেকেই বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নায়ডুরা যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। হয়তো এখনও আছেন। আর বিজেপি-বিরোধী সেই উদ্যোগে এগিয়ে আসে কংগ্রেস এবং প্রায় সব আঞ্চলিক দল।

মমতার ডাকে ব্রিগেড সমাবেশের ‘সাফল্য’-এর পরে দিল্লিতে বৈঠক করে রাহুল, মমতা-সহ বিরোধী নেতারা ঘোষণা করেছিলেন, জোট গড়ে ভোটে যাবেন তাঁরা। কিন্তু বলতেই হবে, বাস্তবে তা হল না। একাধিক রাজ্যে বড় আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে কংগ্রেসের আসন বোঝাপড়াও ভেস্তে গিয়েছে। এতে কোন পক্ষের দায় কত, সেই আলোচনা চলতেই পারে। তবে মোটের উপর বিজেপি-বিরোধী লড়াইতে কংগ্রেস অনেক জায়গায় একটি আলাদা পক্ষ। সেই সব জায়গায় মূল লড়াই অন্তত ত্রিমুখী।

Advertisement

দেশের সর্বাধিক লোকসভা আসনের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি এবং মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির জোটের সঙ্গে কংগ্রেসের বনিবনা হয়নি। সেখানে অখিলেশ ও মায়াবতীর দল একযোগে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়বে। আর এক বড় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি আরও বিচিত্র। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে মমতা যেমন গোড়ায় কোনও উৎসাহ দেখাননি, তেমনই এই রাজ্যের কংগ্রেসও প্রথম থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে না-যাওয়ার পণ করেছিল। দিল্লির হাইকমান্ড তাকে মান্যতা দিয়েছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে জোট-আলোচনার ক্ষেত্রই ছিল না। জোটের অপর এক উল্লেখযোগ্য কুশীলব চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশমের সঙ্গেও অন্ধ্রে কংগ্রেসের আসন-বোঝাপড়া হয়নি। সেখানে লড়াই হবে।

অর্থাৎ সোজা কথায়, বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেস ও আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিজেপিকে হারানোর জন্য একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার সাধারণ সূত্র কার্যত আধপাকা হয়েই রইল। এ বার নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ে আসা দলগুলি ফের বিজেপি-বিরোধিতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হবে কী ভাবে, কোন শর্তে— সে সব পরের কথা। কিন্তু আপাতত জোটের ছবিটা কিঞ্চিৎ ঝাপসা!

শুধু তা-ই নয়, দিল্লিতে বিরোধীদের বৈঠক থেকে ন্যূনতম অভিন্ন কর্মসূচি ভিত্তিক মিলিত ইস্তাহার প্রকাশের যে কথা বলা হয়েছিল, সেটিও দেখা যাচ্ছে বিশ বাঁও জলে! কোথাও কারও মুখে এ বিষয়ে একটি শব্দও এখনও পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। যত দূর জানি, এ নিয়ে বিরোধী দলগুলির মধ্যেও এখনও কোনও আলোচনা হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই যে যার নিজের মতো করে ইস্তাহার প্রকাশ করছে। তবে নিজের দলের ইস্তাহার প্রকাশ করতে গিয়ে মমতা জানিয়েছেন, বিরোধীদের সরকার তৈরি হলে তা অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতেই কাজ করবে।

এমন এক পরিস্থিতিতে সে দিন মালদহে নির্বাচনী প্রচারসভায় রাহুল যা বললেন, তা বিরোধী শিবিরকে অস্বস্তিতে ফেলার মতো নানা উপাদানে ভরপুর। এই রাজ্যে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে বোঝাপড়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই, ধরে নিয়েই জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা মেনে বিরোধী জোট গড়ার উদ্যোগে রাহুল গাঁধী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে গিয়েছেন। প্রাথমিক শীতলতা কাটিয়ে তাঁদের মধ্যে কিছু দিন ধরেই নিয়মিত রাজনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা ও বার্তা বিনিময় চলেছে। পরস্পরের আহ্বানে এক মঞ্চে সভা, এক টেবিলে আলোচনায় শামিল হয়েছেন তাঁরা। এমনকি, রাজ্যে ক্ষয়িষ্ণু বামেদের সঙ্গে জোট গড়ে বিজেপির পাশাপাশি মমতার বিরুদ্ধে লড়ার জন্য অশক্ত প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের লালায়িত চেষ্টা সত্ত্বেও জাতীয় ক্ষেত্রে এত দিন তার বিরূপ ছায়া পড়েনি।

কিন্তু প্রচারে এসে এ বার মোদী এবং মমতাকে একই নিশানায় দাঁড় করিয়ে রাহুল গাঁধী যা বললেন, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য বড় কম নয়। তাঁর অভিযোগ, রাজ্যের উন্নয়নে মমতা কিছুই করেননি। তিনি শুধু মোদীর মতো বড় বড় শূন্যগর্ভ কথা বলেন। বলা যেতেই পারে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাহুলের এই বক্তব্য বিরোধী-ঐক্য প্রচেষ্টার উপর একটি বড় আঘাত। যা রাজ্যে মমতা-বিরোধীদের অবশ্যই খুশি করেছে।

আবার স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, তৃণমূল নেত্রী ও তাঁর সরকার সম্পর্কে এটিই যদি রাহুলের অভিমত হয়, তা হলে বিজেপি-বিরোধী সরকার গঠনের পরিস্থিতিতে তৃণমূলের কাছে কংগ্রেস কী প্রত্যাশা করতে পারে? তৃণমূলই বা কী করবে?

রাজনীতিতে অনেক বেশি অভিজ্ঞ মমতা অবশ্য এখন এ সব প্রসঙ্গে জলঘোলা করতে চাননি। তাই রাহুলের মন্তব্যকে ‘ছেলেমানুষের কথা’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আসলে এই রাজ্যে রাজনৈতিক বাস্তবতা খতিয়ে দেখলে ফের তৃণমূলের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনাই এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট হয়। হয়তো তাই তৃণমূল নেত্রী এ ক্ষেত্রে ‘দুর্বল’কে আঘাত না করার নীতিবাক্যে আস্থা রেখেছেন!

অবশ্য শুধু মমতার দলই নয়, নানা রাজ্যে প্রধান আঞ্চলিক দলগুলির উত্থানের লক্ষণ এ বার বেশ নজরে পড়ছে। বস্তুত জোট-রাজনীতির আদি পর্বে তৃণমূল নেত্রী যখন প্রথম বিজেপির বিরুদ্ধে ফেডারাল ফ্রন্ট তৈরির ডাক দিয়েছিলেন, তখন তারও মূল লক্ষ্য ছিল রাজ্যে রাজ্যে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলির প্রাধান্য নিশ্চিত করা। মানতেই হবে, এ বারের নির্বাচনী ময়দানে সেই প্রাধান্য রীতিমতো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ভোট-ভবিষ্যৎ সর্বদাই অনিশ্চয়তার বিষয়। তবু বিজেপির বিরুদ্ধে বড় আঞ্চলিক দলগুলির সম্মিলিত ভূমিকা দেশের রাজনৈতিক ছবি

বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে

বলে ইঙ্গিতও মিলছে। আর সেটা যদি হয়, তা হলে কংগ্রেস যে তাতে বিলক্ষণ লাভবান হবে, সে তো বলাই বাহুল্য।

রাহুলের মমতা-বিরোধিতা বা মায়াবতীর রাহুল-বিরোধিতার মতো বিষয়গুলিকেও তাই এই নিরিখে বিচার করার সুযোগ রয়েছে। এ সবের মধ্যে আপাত-বিরোধের উপাদান আছে ঠিকই। কিন্তু যা যাচ্ছে তার পাশাপাশিই যা থাকছে, তারও গুরুত্ব কম নয় এবং সব পক্ষ সেটা বোঝে।

তাই ভোটের আগে জোট হোক বা না-হোক, ন্যূনতম কর্মসূচি বেরোক বা না-বেরোক লড়াইটা সকলেরই স্থির লক্ষ্যে। বাকিটা তো ফল বেরোনোর পরে অঙ্কের খেলা! চতুর বুদ্ধিরও বটে!

অতএব সবাই সতর্ক। সবাই সাবধানী। পা পিছলে যাত্রাভঙ্গের ঝুঁকি কেউ নিতে চান না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement