গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পুরুষরা যে কোনও কালে সংসারের কোন কাজ করেননি, এমনটা আমার মনে হয় না। সেকালে বাজার করা, রেশন তোলা, মোট বওয়া, কয়লা ভাঙা, নর্দমা পরিষ্কার, ছাদ ঝাঁট দেওয়া, ট্যাঙ্ক পরিষ্কার, বাড়ি-ঘর মেরামতি, ইঁদুর মারা, ছেলেপুলেদের স্কুলের কেড্স-এ খড়ি রং বোলানো, গঙ্গাজল বয়ে আনা বাগবাজার ঘাট থেকে, আত্মীয়-স্বজন এলে ছুটে পাড়ার দোকান থেকে মিষ্টি আনা, লাইন দিয়ে ছেলেমেয়ের পরীক্ষার টেস্টপেপার কেনা, টেলিফোনের লাইন সারানোর জন্য ছুটোছুটি, ট্রান্সফরমার পুড়ে গেলে ইলেকট্রিক অফিসে দৌড়নো, গাড়ির চাকা বদলানো, মোটরবাইক যত্ন করে মোছা, আত্মীয়-বন্ধুদের অসুখেবিসুখে, বিপদে-আপদে ডাক্তার, উকিলবাড়ি হত্যে দেওয়া, হসপিটালে রাত জাগা, শ্মশান যাত্রা— লিস্টটা বেশ বড়। আমি ঠিক বুঝতে পারি না, কোন কাজটা প্রাত্যহিক সংসারজীবন পালনের বাইরের। আমার এটা বোধগম্য হয় না।
উত্তর কলকাতার যে পাড়ায় আমি বড় হয়েছি, সেই বনেদি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পাড়ায় ধুতির উপর গামছা জড়িয়ে নানা বয়সের পুরুষদের নানান রকম কাজ করতে দেখার কথাই আমার মনে আছে। একেবারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে বাবুগিরি করার মতো লোক বড় জোর দু-চারটে থাকে সব পাড়ায়। আসলে একটা কাজ ভাগাভাগির ব্যাপার ছিল অতীতে— ঘরের কাজ, আর বাইরের কাজ। আবার ঘরের কাজের মধ্যেও কতগুলো কাজ ছিল যেগুলো ধরনে একটু ম্যাসকুলিন। যেমন ধরা যাক, ডাব কাটা। ধরা যাক, গিন্নি এসে বলে গেলেন, “সকাল থেকে খবরের কাগজ মুখস্থ করছ। খাটের তলা থেকে ঝুনো নারকেল বের করে ছাড়িয়ে না দিলে কিন্তু আজ আর চিংড়ির মালাইকারি হচ্ছে না!” কত্তাটি সঙ্গে সঙ্গে কাগজ ভাঁজ করে খাটের তলায় ঢুকে পড়লেন।
এ ভাবেই চলছিল বাঙালির সংসারজীবন, এই ধরা যাক নব্বইয়ের দশকের শেষ অবধি। কাজ করা নিয়ে ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুতি যে ছিল না তা নয়, কিন্তু হিংসেহিংসিটা এত প্রকট ছিল না। খুব দাপুটে (পড়ুন অত্যাচারী) কয়েকজন পুরুষ থাকতেনই কিছু পরিবারে, যাঁরা ভাত একটু ঠান্ডা হয়ে গেলে ভাতের থালা ছুড়ে মারতেন, বা ক্লাব থেকে রাত একটায় ফিরলে তাঁদের গরম লুচি ভেজে দিতে হত, বাচ্চা রাতে কেঁদে উঠলে বাচ্চাকে তুলে আছাড় মারতে যেতেন। কিন্তু এঁরা কোনও কালেই সংসারের মূল স্রোত নন। পরিবারতন্ত্রে, সংসারযন্ত্রে নারীর শোষণ ও অমর্যাদার আরও অনেক অন্যান্য দিক ছিল ঠিকই, কিন্তু সংসারের ঘানি ঠেলায় রোজগার করা ছাড়াও কিছু কাজ পুরুষকেই করতে হত, এটা স্বীকার করে নেওয়া উচিত।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
টানাপড়েন শুরু হল যখন নব্বইয়ের দশকে প্রায় ঘরে ঘরেই মেয়েরা বৃহত্তর জগতের কাজে-কর্মে যোগ দিলেন। সময় আর পরিশ্রমের পরিকাঠামোয় তখন যুগপৎ ঘর, সংসার, সন্তানপালন এবং কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করার ঘূর্ণিতে পড়ে মেয়েদের অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে উঠল। তখনই প্রকট হয়ে দেখা দিল সেই সমস্যাটা, যে সমস্যাটাকে ট্যাকল করার মতো ম্যাচিওরিটি তখন পুরুষের ছিল না। কারণ, পরিবার ও পরিবেশ সেই পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার মতো করে তাকে গড়ে তোলেনি।
আরও পড়ুন: সেনা পিছতে রাজি চিন, কোর কমান্ডার বৈঠকে ‘পারস্পরিক ঐকমত্য’
গত তিরিশ বছরে ‘ওয়ার্কিং মাদার’ শব্দটা আমরা যত শুনেছি, ‘ওয়ার্কিং ফাদার’ শব্দটা তার এক ভগ্নাংশ বারও শুনিনি। কিন্তু শোনা উচিত ছিল। ‘ওয়ার্কিং ওম্যান’ শুনছি আজও, ‘ওয়ার্কিং ম্যান’ এক বারও শুনছি না। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার কারণে ঘরের কাজ করে নিজের মেধার বিকাশের লক্ষ্যে মেয়েদের আরও গভীর ভাবে জর্জরিত হতে দেখলাম আমরা আরও বেশ কিছু বছর। সেই ডিমান্ডের মুখে সম্পর্কের ইকুয়েশন বদলাল, একের পর এক দাম্পত্যের পতন হতে লাগল। ব্যক্তি স্বাধীনতা, ইগো, শোষণ বা শোষণ না করতে পারা, সব মিলিয়ে সমাজের চেহারাটাই বদলে গেল। ‘অ্যাডজাস্ট’ শব্দটা প্রেম, মায়া, মমতার থেকে দরকারি হয়ে উঠল।
বলা বাহুল্য, নিঃশব্দে কিছু পরিবর্তন হচ্ছিল এই বাঙালি জাতির জীবনেও। এক ধরনের কালচারাল ট্রানজিশনের মধ্যেই ছিল বাঙালি পুরুষ। পুরুষের অতিরিক্ত ম্যাসকুলিনিটিকে আর তেমন পছন্দ করছিল না আধুনিকতা। বরং ঘরোয়া রাজনীতি বিজ্ঞাপনে, ব্যানারে, ফেস্টুনে আর একটু সহমর্মী, একটু নরম, একটু বেশি কেয়ারিং, একটু ডোমেস্টিকেটেড পুরুষকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিল বেশি বেশি করে। পুরুষ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে লং ড্রাইভে নিয়ে যাবে— এই স্বপ্নের জায়গায় পুরুষ অফিস থেকে ফিরে একটু মিষ্টি হেসে শার্টের হাতা গুটিয়ে বাসন মাজবে, মাঝরাতে বাচ্চার ন্যাপি বদলে লালাবাই শোনাবে, জন্মদিনে কেক বানিয়ে চমকে দেবে, এ সব স্বপ্ন দেখছিল নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী মেয়েরা এবং বলা উচিত নয়, এই শেষবেলায় স্বপ্নগুলো বাস্তবেও ঘটছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ঠিক এই রকম সময়ে করোনাকালের লকডাউন শুরু হয়ে গেল।
আরও পড়ুন: উত্তেজনার আবহেই বৈঠকে মুখোমুখি ভারত-চিনের বিদেশমন্ত্রী, রয়েছে রাশিয়াও
লকডাউনের প্রাথমিক পর্যায়ে, মানে প্রথম সাত-আটদিন পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রেখে বোঝা গেল, পরিবর্তনটা যে স্লো প্রসেসে হচ্ছিল সেটারই হঠাৎ গতি বেড়ে যাওয়ায় চোখে অন্ধকার দেখছে বাঙালি পুরুষসকল। এও বোঝা গেল, মানুষকে যতটা আধুনিক বাইরে থেকে মনে হয়, ততটা আধুনিকতা এখনও তার অন্দরমহলকে স্পর্শ করতে পারেনি। মোদ্দা কথা বোঝা গেল যে, পুরো সময়টাই মেয়েরা কতটা আধুনিক হয়েছে এটা বোধগ্রাহ্য করে তুলতে গিয়ে, আমরা কেউ নজরই দিইনি ছেলেরা কতটা আধুনিক হল বা আদৌ হল কি না সেই দিকে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পুরো পরিস্থিতিটাই এক নিমেষে পরিষ্কার হয়ে গেল আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার, বাড়িতে বাড়িতে মহিলাদের সংসারের কাজে সাহায্যকারিণীরা আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। আর যাই হোক, যে যাই বলুক, ছেলেরা যে কোনও কালেই ঘর মোছা, বাসনমাজা, কাপড় কাচা, কাপড় মেলা, তোলা, ইস্ত্রি করা, ভাঁজ করা, ড্রয়ারে ঢোকানো, রান্না করে কিচেন পরিষ্কার, বাথরুম পরিষ্কার, ফ্রিজ পরিষ্কার, সপ্তাহান্তে কুশন কভার বদলানো, কিংবা মাসান্তে আলমারি গোছানো বা পর্দা পাল্টানোর মতো অসংখ্য, অজস্র ভারী ভারী ও কুচো কুচো কাজ এবং সেই সঙ্গে ছোট বাচ্চা মানুষ করা, তাকে চব্বিশ ঘণ্টা নারচার করার বা একটু বড় বাচ্চার দেখাশোনা, পড়াশোনা, হোমওয়ার্ক ইত্যাদিতে সাহায্য করার যে সব মিলিয়ে প্রকাণ্ড পরিশ্রম ও এনগেজমেন্ট— তার কোনওটাতেই সম্পূর্ণ মাথা লাগায়নি কোনও দিন, সেটা একদম দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে বোঝা গেল সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সম্মিলিত হাহাকারে। ওই একটু চা করা, একটু গাছে জল দেওয়া, ওই উঁচু পাখার ঝুলটা একটু ঝেড়ে দেওয়া— এ সবের মধ্যে দিয়ে তারা চেষ্টা করছিল ঘরে, বাইরে পা মিলিয়ে চলার। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে, এই নিয়ে যত মিম তৈরি হল, যত জোক ঘুরতে লাগল হোয়াটস্অ্যাপে, তাতে বোঝা গেল বাঙালির ঘরোয়া জীবনে ছেলেরা মোটেও কখনও ঘর মোছা, বাসন মাজার কাজ করেনি। লকডাউনে এই গৃহকর্মে লিপ্ত হওয়ার পুরো বিষয়টাই গৃহবন্দিদের কাছে একটা ‘ফান’ হয়ে দাঁড়াল বলেই বোঝা গেল যে, কেউই এই বিষয়টা নিয়ে এতটুকু সিরিয়াস নয়। লকডাউন উঠে যাওয়ার অপেক্ষা মাত্র। লকডাউন উঠে যাবে, সবাই আবার আগের অবস্থানে ফিরে যাবে।
ফলে যাঁরা বাঙালির জীবনে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এখুনি আশা করছেন, তাঁরা ভুল করছেন। না, ভবিষ্যতে আপনি চট করে কারও বাড়ি গিয়ে দেখবেন না বাড়ির পুরুষটি পোস্ত বাটতে বাটতে গজগজ করছেন, “এত তাড়াহুড়োর মধ্যে আজ আবার শখ হয়েছে মৌরলা মাছের সর্ষে পোস্ত খাবেন! উইক ডে-তে এত রান্না করা পোষায়?” আপাতত শান্তিকল্যাণের লক্ষ্যে যে ছেলেরা ঝাঁটা, ন্যাতা ধরেছেন তাঁদের শুধু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা। করোনাকালে যে সব মহিলারা এমার্জেন্সি সার্ভিসে আছেন তাঁদের বাড়ির কথা আলাদা, অন্যত্র খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই তিন মাসের লকডাউনে পুরুষদের অনেকেই নিজেদের সেই চিরাচরিত ভূমিকায় ফিরে গেছেন। আর সত্যি কথা বলতে, অনেক বাড়িতেই ডোমেস্টিক হেল্পরা আবার কাজে যোগ দেওয়ায় মহিলারাও আর ‘গৃহকর্মে নিপুণ নয়’-প্রজাতিটিকে নিয়ে আর ততটা মাথা ঘামাচ্ছেন না।
এখান থেকে আলোচনাটা একেবারে একটা সিরিয়াস নারীবাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে চাই।
যে কোনও বিষয়ের উপর একটা উল্টো ন্যারেটিভ দাঁড় করানো আমার একটা প্রধান পছন্দ। তাই শুনতে খারাপ লাগলেও অন্য যে চিন্তাটা আমার মাথায় ঘুরপাক খায়, সেটা হল— যেখানে আধুনিকতা ও নারীবাদ গৃহকর্ম, বাচ্চা মানুষ করা এই কাজগুলোকে আর ততটা সম্মানের আসনে রাখেনি, সেখানে বহির্জগৎ-বিলাসী পুরুষকে নতুন করে এটা কী ভাবে বোঝানো হবে যে, মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে পরিবার ব্যবস্থা বজায় রাখতে ও সন্তান উৎপাদনে ঘর, সংসারকে সচল রাখাটা অত্যন্ত জরুরি একটা প্রক্রিয়া? কী ভাবে পুরুষকে বোঝানো যাবে যে, সেখানে উপার্জন করাটা যতটা প্রয়োজনীয় ঠিক ততটাই দরকার গৃহকর্মে পারদর্শী হয়ে ওঠা? এবং বাইরের কাজে যে সম্মান, ঘরের কাজেও সেই একই সম্মান? কারণ শেষ বিচারে কয়েক হাজার বছর ধরে শুধু গৃহে আবদ্ধ থাকা নারী নিজেই জানে যে, রাঁধার পর খাওয়া আর খাওয়ার পর রাঁধার চর্বিতচর্বণের মধ্যে কোথাও কোনও অলীক মানসিক তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে না। একটা গোটা জীবনকে এটুকু কোনও মতেই সমৃদ্ধ করে না, পরিপূর্ণ জীবন বাঁচতে বাইরের পৃথিবীটাকে এক্সপ্লোর করাটা খুব দরকার। আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই ঘরকন্নার কাজকেই আবার কী প্রকারে পুরুষের কাছে গ্লানিহীন ও আকর্ষণীয় করে তোলা হবে— এটাই তো সমাজবিজ্ঞানের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তা হলে যে যে প্রকরণগুলো দিয়ে নারীকে বোঝানো হয়েছিল সংসারের জন্য খেটে যাওয়াই তার জীবনের আসল মোক্ষ, সেই প্রকরণগুলোকেই কি একটু ওলটপালট করে পুরুষের দিকে বাড়িয়ে ধরতে হবে তাকে এই সংসারের তুচ্ছ কাজগুলোয় উৎসাহী করে তুলতে? সংসার করার মোহ, মায়া, হাতছানির একটা ম্যাসকুলিন মেকওভারের আসলে এখুনি প্রয়োজন। তা না হলে পুরুষের ভিতর এই পালাই পালাই ভাবটা থাকবে। কারণ কেউ কেউ ঠেকে শেখে, কেউ কেউ দেখে শেখে। সভ্যতায় নারীর অতীত দুরবস্থা থেকে পুরুষ তো এটাই শিখেছে যে, সংসারজীবনে আমূল নিমজ্জিত হওয়ার মতো বোকামি আর কিছুতে হয় না।