Coronavirus

কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে

একবার ভেবে দেখুন ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি জাতির একটা বড় অংশ আজ ষাট দিন ধরে বাড়ির বাইরে পা রাখেনি। অগত্যা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হিড়িক উঠেছে মানস ভ্রমণের। ইউটিউবে দেশ বিদেশের বিভিন্ন ঘুরতে যাওয়ার ভিডিও দেখে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। লিখছেন সৌরভ চক্রবর্তী।অদূর ভবিষ্যতে সেই দশা কাটারও বিশেষ লক্ষণ নেই।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২০ ০৩:০৪
Share:

প্রতীকী ছবি

বাঙালি ঘুরতে ভালবাসে না, অতি বড় নিন্দুকেও এই অপবাদ দিতে পারবে না। পৃথিবীর যে কোনও দেশে, যে কোনও স্থানে চলে যান, একটা আধটা বাঙালি রেস্তোরাঁ পাবেনই। বাঙালি রেস্তোরাঁ মানে বাঙালির হাতের ছোঁওয়ায় নানা বাংলার পদ মেলে যেখানে। পাড়ার মোড়ে মোড়ে বাবুদার চাইনিজ খাবারের দোকানের মতো নয়। কিন্তু সেই বাঙালি আজ দু’মাস হল গৃহবন্দি।

Advertisement

অদূর ভবিষ্যতে সেই দশা কাটারও বিশেষ লক্ষণ নেই। করোনার প্রতিষেধক আসার আগে পর্যন্ত লকডাউন উঠে গেলেও মানুষ খুব একটা বেড়াতে যাবে তেমন আশা করছেন না কেউই। মার্চ, এপ্রিল, মে এই তিনটি মাস আমাদের পক্ষে বেড়াতে যাওয়ার আদর্শ সময়। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ, স্কুল কলেজে গরমের ছুটি, হাঁসফাঁস গরম থেকে বাঁচতে এই সময়টাকেই ঘুরতে যাওয়ার জন্য বেছে নেয় বাঙালিরা। মোটামুটি মাস চারেক আগে থেকেই উত্তরবঙ্গগামী সমস্ত ট্রেনের রিজার্ভেশন তালিকায় জমা পড়তে থাকে দীর্ঘ ওয়েটিং লিস্ট।

গরম কালে পাহাড়ের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় অনেকেরই আছে, যাদের নেই তারা গিয়ে একবার মিলিয়ে দেখে নেবেন, প্রধানত যদি দার্জিলিং-এর ম্যাল বা গ্যাংটকের এম জি মার্গে যান, তবে বড়বাজারের সাথে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য হবেন। পাহাড়ি আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটটা বাদ দিয়ে দিন, দেখবেন শুধুই বাঙালি মুখ, বাঙালি কথা, বাঙালি দরদাম, আর বাঙালি চিৎকার। শুধু পাহাড় নয় অন্যত্রও ছবিটা প্রায় একই রকম। একবার মহারাষ্ট্র-এর অজন্তা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তো সেই অজন্তা গুহার আশেপাশে বেশকিছু খাবারের দোকানে মারাঠি কর্মচারীদের মুখে স্পষ্ট উচ্চারণে রুই মাছ, বাটা মাছ, পোনা মাছের অমোঘ আহ্বান শুনতে পেয়েছিলাম। প্রায় সর্বাংশে নিরামিষাশী মারাঠিরাও বাঙালি খদ্দেরের ভিড় সামলাতে মাছের রান্না ও মাছের নাম দুটোই বাঙালি কায়দায় শিখে ফেলেছে।

Advertisement

অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসলে তালিকাটা অস্বাভাবিক দীর্ঘ হয়ে যাবে, তবুও এই প্রসঙ্গে গোলকুণ্ডার তেলেগু গাইডের কথায় কথায় 'বুঝতে পারলেন', 'খুব ভাল', 'ধন্যবাদ' শব্দগুলোর ব্যবহার ভোলার নয়। বেনারসে গিয়েও দেখেছি বাংলায় নাম লেখা দোকানের দীর্ঘ সারি। এতগুলো কথা বলার মোদ্দা কারণ একটাই, বাঙালি ঘুরতে ভালবাসে। শুধু ভালবাসে নয়, বেড়াতে যাওয়া বিষয়টা তার বার্ষিক অতিপ্রয়োজনীয় তালিকার অংশবিশেষ।

একবার ভেবে দেখুন সেই বাঙালি জাতির একটা বড় অংশ আজ ষাট দিন ধরে বাড়ির বাইরে পা রাখেনি। অগত্যা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হিড়িক উঠেছে মানস ভ্রমণের। ইউটিউবে দেশ বিদেশের বিভিন্ন ঘুরতে যাওয়ার ভিডিও দেখে দিন কাটাচ্ছ। ট্রাভেল ব্লগের দর্শক সংখ্যা গত দু’মাসে হু হু করে বেড়েছে। মোবাইল ল্যাপটপ আর ট্যাবলেটের স্ক্রিনেই ঘণ্টাখানেকের জন্য আমরা হারিয়ে যাচ্ছি সুদূরে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুকাল আগেই লিখে গিয়ে ছিলেন, “কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে।” তিনি করোনা পরিস্থিতি দেখে যাননি, তবে বিনা পয়সায়, বিনা পরিশ্রমে, কম সময়ে মানস ভ্রমণের উপযোগিতা তিনিও বেশ ভালই উপলব্ধি করেছিলেন। মহাভারতে যক্ষও যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আলোর চেয়ে দ্রুতগামী কে?” যুধিষ্ঠির উত্তর দিয়েছিলেন, “মন”। এই লকডাউন অবস্থায় বাঙালিও ভরসা রেখেছে সেই মনের উপরেই। আর তার দোসর হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া।

ইউটিউবের পাশাপাশি ফেসবুকও পুরনো দিনের স্মৃতি মনে করানোর যে গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তাও অনেকক্ষেত্রে পুরনো দিনের ভ্রমণের স্মৃতিকে উস্কে দিচ্ছে। সঙ্গে আছে কিছু ট্রাভেল পেজ, যারা একসময় বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যাওয়ার সুলুকসন্ধান দিত, তারাও এখন মানসভ্রমণের বন্দোবস্ত করছে। দেশ বিদেশের নানা জায়গার ছবি ও ভিডিও আপলোড করে তারা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর ব্যবস্থা করছে।

শুধু তাই নয়, এই ট্রাভেল পেজগুলোতে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে ভবিষ্যতের ভ্রমণ পরিকল্পনা। গরমের ছুটি মাঠে মারা গিয়েছে, এখন একমাত্র পাখির চোখ পুজোর ছুটি, তাকে কোনও ভাবেই হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না। তাই সেই ছুটিকে লক্ষ্য রেখেই শুরু হয়েছে নতুন ভ্রমণের পরিকল্পনা সাজানো। আদৌ যাওয়া হোক বা না হোক পরিকল্পনা করতে তো দোষ নেই, তাই ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন নতুন জায়গার তত্ত্বতালাশ। এই ঘটনাও বাঙালির জীবনে নতুন নয়। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার মাস পাঁচেক আগে থেকেই তার পরিকল্পনা করা এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ার গৌরবময় ঐতিহ্য আমাদের আছে। কলেজ জীবনে পাঁচজন বন্ধু পাশাপাশি বসে একবারও গোয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেনি, এই ঘটনা বিরল। আবার একই রকম ভাবে একথাও সত্যি যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই পরিকল্পনা ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে বা খুব বেশি হলে দীঘার সমুদ্র উপকূলে গিয়েই আছড়ে পড়েছে। আসলে আমরা মনে মনেও ঘুরতে ভালবাসি। কোথাও একটা যাওয়ার আগে সেই জায়গা নিয়ে কল্পনায় স্বপ্নের জাল বুনতে ভালবাসি। পৃথিবীর আরও অনেক জাতি যেমন মানসিক অবসাদ দূর করতে, কয়েকটা দিন কাজের থেকে ছুটি পেয়ে কিংবা কোনো কাজের সূত্রেই বেড়াতে যায়, আমাদের সেসবের বালাই নেই। আমরা ঘোরার জন্যই ঘুরতে যাই, অফিস কামাই করে ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাই। বছরে দশ দিনের ঘুরতে যাওয়া নিয়ে আমরা বাকি দশটা মাস স্মৃতি রোমন্থন করে কাটিয়ে দিতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই কল্পনাই আমাদের একমাত্র সম্বল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই কল্পনার চর্চা আমাদের আজকের নয়। সেই অতীত চর্চাই আজ বেঁচে থাকার রসদ জোগাচ্ছে আমাদের।

সোশ্যাল মিডিয়ায় পুরনো স্মৃতি রোমন্থনের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের ভ্রমণ সংক্রান্ত কৌতুকও ছড়িয়ে পড়েছে। গৃহবন্দি দশায় ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোটাকেও নেটিজেনরা বেশ কৌতুকের আকারে প্রকাশ করছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একটি পোস্ট হয়তো অনেকেরই চোখে পড়েছে যেখানে পোস্টকারী লিখছেন, “আজ সকালে উঠেই 'বাথরুমগড়' থেকে ঘুরে এলাম, সেখান থেকে বেড়িয়ে 'রান্নাঘর ধামে' ঢুকে একটু চা প্রসাদ খেয়েই ছুট লাগিয়েছি 'বারান্দা নগরের' দিকে। আজ মধ্যাহ্নভোজটা 'ডাইনিং প্যালেসেই' সারব, তারপর সন্ধ্যাবেলায় শিরশিরে হাওয়া খেতে 'ছাদ টক-এ' যাব”।

এই পোস্টে হাস্যরসের উপাদান নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকতেই পারে। কিন্তু একটা কথা সকলেই নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন যে, ভ্রমণ ব্যাপারটা বাঙালির মজ্জাগত। তাই গৃহবন্দি দশার কষ্টটাকে কৌতুকের আকারে প্রকাশ করতেও সে ভ্রমণেরই আশ্রয় নেয়। লকডাউন কেটে গেলে এবং প্রতিষেধক আবিষ্কার হলে বাঙালি যে আবার বেড়াতে বের হবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানোগুলো শুধু ভাল লাগাকেই উস্কে দিচ্ছে না, একই সঙ্গে বেশ কিছু সমাজসেবামূলক দৃষ্টান্তও স্থাপন করছে। কিছুদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ার একটি ট্রাভেল পেজে এক ভ্রমণপ্রেমী ব্যক্তি তুলে ধরেন তাঁদের কথা যাঁরা পর্যটনের উপরেই সবদিক থেকে নির্ভরশীল। বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মহীন অবস্থায় যে দুঃসময় তাঁরা কাটাচ্ছেন, তার থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য আর্থিক সহায়তাও করা হয় পেজটির মারফত। এই ঘটনা হয়তো বিক্ষিপ্ত। হয়তো এই আর্থিক সহায়তা সামান্য কিছু পরিবারের হাতেই পৌঁছাবে, কিন্তু তবুও বর্তমানে মানুষ যখন বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয়ে আচ্ছন্ন, তখনও যে আমরা সুখের খোঁজে, শান্তির খোঁজে ভ্রমণের স্মৃতি হাতড়াচ্ছি, হাতড়ে পৌঁছে যাচ্ছি দেশ থেক বিদেশ, পাহাড় থেকে সমুদ্র; এই অবস্থায় সেটাই বা কম কী?

গুপী গাইন বাঘা বাইনের মতো ভূতের রাজার দেওয়া জুতো আমাদের কাছে নাই বা থাকুক আমাদের কাছে ভ্রমণপিপাসু মন আছে। সেই মন নিয়েই মেঘের সঙ্গী হয়ে ঘরবন্দি অবস্থায় থেকেও আমরা উড়ে চলেছি দিকদিগন্তের পানে। এই উড়ানই বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখবে, বাঙালির সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement