প্রতীকী চিত্র।
এক বেসরকারি চাকুরে বন্ধুর ছেলে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। বন্ধু ও তার স্ত্রী এত দিন ছেলেকে ঘরে কুটোটি নাড়তে দেয়নি; শুধু লেখাপড়া করেছে ছেলে। লকডাউনে বন্ধুর চাকরি গিয়েছে। অগত্যা ছেলেটি নিজের পড়ার খরচ আর হাতখরচ জোটানোর জন্য টিউশন শুরু করেছে। তা নিয়ে বন্ধুটি একান্তে প্রচুর দুঃখ করায় তাকে বললাম, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলিতে এই বয়সি ছেলেমেয়েরা সকলেই কিছু না কিছু কাজ করে নিজেদের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করে। শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করতে শেখাটা মোটেও লজ্জার কিছু নয়।
লকডাউনের হাজার খারাপের মধ্যেও এ এক ভাল দিক— যে কাজগুলো স্বাভাবিক ভাবে পারা উচিত, অথচ কখনও পারিনি, সেগুলোর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। তিন মাসের লকডাউন এবং তার পরবর্তী আরও পাঁচ মাসের প্রলম্বিত ‘অ-স্বাভাবিকতা’ যেমন মধ্যবিত্ত পুরুষকে ঘরের কাজে হাত লাগাতে শেখাল, খানিক হলেও। টুকটাক রান্নাবান্না (ইউটিউব দেখেই সই), বাসন মাজা বা কাপড় কাচার কাজ করে দেখা গেল, ‘দশভুজ’ হয়ে ওঠাটা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়।
লকডাউন বহু মানুষকে জীবিকা বদলাতে বাধ্য করেছে। বাচ্চাদের স্কুলের পুলকার চালাত যে যুবক, তাকে পাড়ার মোড়ে ঠেলাগাড়িতে করে ফল বিক্রি করতে বেরোতে হয়েছে; কল সেন্টারের কাজ হারানো মেয়েটি ইন্টারনেটে অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় হাত পাকাতে শুরু করেছে; স্টেশন চত্বরে ফাস্ট ফুডের স্টল চালানো মধ্যবয়স্ক লোকটি এখন আনাজ নিয়ে বসছেন স্থানীয় বাজারের বাইরে, রাস্তার ওপর। এই পথে হেঁটে কিছু নিবিড় আত্মোপলব্ধিও ঘটেছে। শ্রমজীবী মানুষের পরস্পরের প্রতি ‘সমানুভূতি’, মমত্ববোধ জেগেছে। সেটাও কি নেহাত কম কথা? পেশাদার দর্জি থেকে মাছ বিক্রেতায় পরিণত হওয়া এক বন্ধু সে দিন গল্পের ছলে বলছিল, “চির কাল ভেবে এসেছি, বাজারের মাছওয়ালারা গাদা-গাদা টাকা কামায়।
কিন্তু এখন রোজ অন্ধকার থাকতে উঠে পাঁচ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মাছের আড়তে গিয়ে, জল-কাদা ঠেঙিয়ে নিলামে মাছ কিনে, দুপুর পর্যন্ত বসে বসে সেই মাছ বিক্রি করতে গিয়ে ওদের কষ্টটা বুঝতে পারছি।” সম্প্রতি আবার তার ছোট্ট দোকানটি খুলে সেলাই মেশিন চালু করতে পেরেছে আমার সেই বন্ধু। আশা করা যায়, আগামী দিনে মাছের বাজারে গিয়ে মাছ-বিক্রেতাদের সে একটু হলেও অন্য নজরে দেখবে।
সংসারের দশ রকম কাজের চাপে হারিয়ে যাওয়া শিল্পীসত্তাগুলোকেও অনেকটা জলমাটি দিল এই লকডাউন। লকডাউন হল বলেই না ধুলো ভরা হারমোনিয়ামটা, ইজ়েল আর রঙের বাক্সগুলো, ঘুঙুরগুলো কিংবা লেখার প্যাড আর কলমটা বার করা হল। নতুন কিছু সৃষ্টি হল। তার কিছু ভরা রইল আন্তর্জালে, কিছু স্মৃতিসুধায়।
কিন্তু, আমরা সব কিছুকেই তাৎক্ষণিকতায় বিচার করতে ভালবাসি। এবং আমরা বড় বিস্মৃতিপরায়ণ। অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার অভ্যাস আমাদের নেই। ঠিক যেমন ভাবে এই অতিমারি-ধ্বস্ত পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালের অপরিহার্যতা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলেও আমরা অচিরেই সে সব ভুলে আবার বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হব, তেমন ভাবেই হয়তো নতুন পাওয়া উপলব্ধিগুলোকেও ভুলে যাব। আমাদের মনে থাকবে না, লকডাউন আমাদের নারীর গৃহস্থালির শ্রমের মূল্য চিনিয়েছিল, বুঝিয়েছিল খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-যন্ত্রণা। এবং এও শিখিয়েছিল যে, শিল্পচর্চাটা শৌখিন মজদুরি নয়, রীতিমতো ঘষামাজার জিনিস, সাধনার ধন।
অতিমারি ও লকডাউন যে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকে টেনে আনতে পারেনি, তার একটা প্রধান কারণ সম্ভবত এটাই যে, পাড়ায় পাড়ায় কমিউনিটি কিচেন খুলে, একা পড়ে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাড়িতে খাবার-ওষুধ-নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিয়ে, অসুস্থকে হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে প্রায় একটি সমান্তরাল ব্যবস্থাকে চালিয়ে গিয়েছেন কিছু মানুষ। গোটা লকডাউন পর্ব জুড়ে। তাঁরা সবাই সাধারণ মানুষ।
পরিস্থিতি তাঁদের অ-সাধারণ করে তুলেছিল। এমন অনেক মানুষ ছিলেন আমাদের চার পাশে, কর্মহীন প্রতিবেশীর আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে যাঁরা চুপচাপ তাঁদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়েছেন বা চাল-ডাল-আনাজ ভর্তি একটা ব্যাগ নিঃশব্দে রেখে এসেছেন তাঁদের দরজায়। সরকারি হাসপাতালে রোগীর আত্মীয়স্বজনদের জন্য টানা তিন মাস কমিউনিটি কিচেন চালিয়ে গিয়েছেন একদল বন্ধু। সে জন্য তাঁরা বিপ্রতীপ রাজনৈতিক দলের বিধায়কের অর্থসাহায্য নিতেও দ্বিধা করেননি। দলনেতার সাফ কথা ছিল, “আগে তো মানুষ বাঁচুক, রাজনীতির লড়াই পরে লড়ে নেওয়া যাবে’খন।”
লোকাল ট্রেন চালু হল। স্তব্ধ হয়ে থাকা সভ্যতার চাকা আবার সচল হতে শুরু করেছে। লকডাউনের এই উপলব্ধিগুলো ভবিষ্যতেও আমরা হৃদয়ে ধরে রাখতে পারব তো? না কি ব্যস্ততার ফুটো পকেট গলে তা হারিয়ে যাবে চেনা আধুলির মতো?