কাদের প্রাণের বিনিময়ে?
Corona Virus

সুস্থ অর্থনীতি বনাম সুস্থ শরীর? একটি নিষ্ঠুর বিতর্ক

আজকের হাত-খালি মানুষকে যদি প্রশ্ন করা যায়, আপনারা নিয়মিত রোজগার চান না তালাবন্দি হয়ে নিজের ও অন্যদের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে চান, অনেকের জবাবই অনুমান করতে অসুবিধে হয় না

Advertisement

দীপেশ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০ ০০:০১
Share:

তর্কটা উঠবে জানতাম, কিন্তু কখন, কী ভাষায় উঠবে জানতাম না। এই তালাবন্দি অবস্থা কত দিন চলবে? করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হতে— যদি হয়— এখনও দেড়-দু’বছর অন্তত বাকি, সমস্ত করোনা-আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে কি না তাও অনিশ্চিত, কিন্তু কত দিন মানুষ কর্মহীন, আয়হীন, অথবা মুনাফাহীন ভাবে ঘরে বসে থাকবে? আর যাঁদের ঘর নেই, চাল নেই চুলো নেই, যাঁরা দিন আনেন দিন খান, তাঁদেরই বা কী হবে? এ ভাবে বেশি দিন চললে সমস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাই সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়বে না কি? তালাবন্দি শেষ হবে কবে? এই তর্কটিই সে দিন শুনলাম একটি ভারতীয় চ্যানেলের এক সাক্ষাৎকারে। প্রবীণ ও সম্মাননীয় অনুষ্ঠান সঞ্চালক প্রশ্নটা তুললেন এক চিকিৎসাবিদ্যা বিশেষজ্ঞর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। জিজ্ঞেস করলেন, “যে কোনও গণতন্ত্রকেই কি আজকের অবস্থায় একটি অপ্রিয় ও কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না যে, দেশের অর্থনীতি ও বাজারকে আমরা চির কাল পঙ্গু করে রাখতে পারি না, অতিমারির অবস্থা যাই হোক না কেন? সুস্থ শরীর যেমন মানুষের প্রয়োজন সে রকম সুস্থ অর্থনীতিরও তো প্রয়োজন আছে— এই বিতর্ক কি ক্রমশ জরুরি হয়ে উঠছে না”? ইংরিজিতে সর্বভারতীয় প্রোগ্রামটি হচ্ছিল, তাই ইংরিজিতে বললেন, “মেডিক্যাল হেলথ ভার্সাস দ্য হেলথ অব দি ইকনমি’’।

Advertisement

কথাটায় অবশ্যই একটি যুক্তি আছে। তালাবন্দি ব্যবস্থা চালু রাখতে গেলে গরিবের যত্ন নিতে হয় ও তা খরচসাপেক্ষ। এই কথাটা বোঝা শক্ত নয়। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার সেই কথা মনে করে অনেক ব্যবস্থাও নিয়েছেন। প্রশ্ন হল, এই খরচ কত দিন চলবে? এমনিতে আমাদের সমাজে উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাশালী মানুষেরা যে ভোটের সময় না এলে গরিবকে নেকনজরে দেখেন না, তার উদাহরণ ভুরি ভুরি। দৈনন্দিন জীবনে বেশির ভাগ গরিব মানুষ থাকেন সামাজিক অপমানের মধ্যে। এই কাগজের কি এমন কোনও পাঠক আছেন গত কয়েক দিনে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা ও অপমানের ছবি দেখে ও বৃত্তান্ত পড়ে যাঁর চোখে জল না মনে ক্ষোভ জমা হয়নি? তালাবন্দির পক্ষে অনেক যুক্তি ছিল বা আছে, তা অস্বীকার করা যায় না। আবার তালাবন্দিতে গরিবের কষ্টটাও অনস্বীকার্য। এক জন মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত মানুষের কাছে তালাবন্দি অবস্থার যে মানে হয় বা ওই অবস্থায় তাঁর যা অভিজ্ঞতা হয়, তার সঙ্গে গরীব মানুষের অভিজ্ঞতার কোনও তুলনা চলে না। আমরা সত্যিই বাড়িতে বসেও কিছু কাজ করতে পারি, মাসমাইনে পাওয়াটাকে ন্যায্য ভাবতে পারি। গরিবের ক্ষেত্রে— নানান কারণবশত— অভিজ্ঞতা অন্য রকম। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতারই বা আমরা কতটুকু জানি? খবরের কাগজের পাতায় বিখ্যাত মানুষদের ‘করোনা-ডায়েরি’ পড়ি। ভালোও লাগে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেই ‘নেড়ি কুকুরের ট্র্যাজেডি’র মতো কোনও দিন লেখা হয়না তালাবন্দিতে একজন দিনমজুরের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তবে এইটুকু বুঝতে করতে অসুবিধে হয় না যে, বিনা-কম্পিউটার, বিনা-মাসমাইনে, বিনা-খাদ্যডেলিভারির সংসারে তালাবন্দির অর্থ যা দাঁড়াবে তা সচ্ছল বা উচ্চবিত্তের অভিজ্ঞতার মতো একেবারেই নয়।

ভারতে তালাবন্দি হয়ে সরকার ও প্রশাসন আমাদের দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কিছুটা করোনা-মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করার সময় পেয়েছেন। আরও কিছু দিন চললে তাঁরা আরও সময় পাবেন কিন্তু তার সামাজিক শর্ত হবে আরও বেশ কিছু দিন সরকারি ও বেসরকারি অনুদানে গরিব মানুষের স্বার্থের দিকে নজর রাখা। বিষয়টি নিশ্চয়ই ব্যয়সাধ্য, কিন্তু সরকার ও উচ্চবিত্তকে স্থির করতে হবে সেটাই ন্যায্য পথ, না কি অর্থনীতির স্বাস্থ্যের প্রশ্নটাই এখন সমধিক জরুরি। এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে বাজার আবার চালু হলে গরিবের অনেক আশু-আয়ের পথ খুলে যাবে। সমাজের অস্থিরতা এড়ানোর জন্য তা প্রয়োজন, এমনও কেউ বলতে পারেন। কিন্তু অতিমারিটি তো যায়নি (আর গরম পড়লে পিছু হটবে, এমন কোনও নিশ্চিতিও নেই)। ফলে তড়িঘড়ি বাজার খুলে দিলে অসুখটির মোকাবিলা করার রণকৌশলের মধ্যে এটা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হবে যে অনেকেরই কোভিড-১৯ অসুখটি হবে, তার মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ সেরে উঠলেও সংখ্যায় লঘু কিছু মানুষ মারা যাবেন।
লিখলাম বটে ‘কিছু মানুষ’— কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে গোষ্ঠী-সংক্রমণ অনিবার্য ধরে নিয়ে যে সংখ্যাটা দেন তা শুনলে কোনও ইউরোপীয় দেশ, মায় নিষ্ঠুর আমেরিকা পর্যন্ত, চমকে উঠত। তবে ভারতবর্ষে জনসংখ্যা প্রচুর, প্রত্যেক বছরে প্রায় সত্তর-আশি লক্ষ মানুষ মারা যান। সংখ্যাতাত্ত্বিকদের ভাষায় কোভিড-১৯ হয়ে যত মানুষ মারা যাবেন, তা প্রতি বৎসর ভারতে যত মানুষ মারা যান সেই সংখ্যার তুলনায় একটু ‘ব্লিপ’-মাত্র, অর্থাৎ ‘স্বাভাবিক’ মাত্রা থেকে অল্প বিচ্যুতি।

Advertisement

কিন্তু করোনায় মারা যাবেন কারা? যাঁদের শরীরে বয়স, অপুষ্টি, ও পূর্ব-অসুস্থতার কারণে করোনা ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কম। বলা বাহুল্য, এঁদের বেশির ভাগই হবে সেই সব গরিব মানুষ যাঁদের বেকারত্ব, অসুবিধে, ক্ষোভ, ও রোষ এড়ানোর জন্য বাজার আবার খুলে দেবার তর্কটা উঠেছে। আজকের হাত-খালি মানুষকে যদি প্রশ্ন করা যায়, আপনারা নিয়মিত রোজগার চান না তালাবন্দি হয়ে নিজের ও দশের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে চান, তাঁদের অনেকের জবাবই অনুমান করতে অসুবিধে হয় না।

গরিবের এ দিকেও মার, ও দিকেও মার। যে বিশ্বায়িত পৃথিবী করোনা ভাইরাস গোটা দুনিয়ায় ছড়াল, তার সুযোগসুবিধাগুলিতে তাঁরা ভাগিদার নন। আবার গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হলে বেশির ভাগ মানুষই অসুস্থ হয়ে সেরে উঠবেন সন্দেহ নেই, তাঁদের শরীরে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতাও তৈরি হবে, তার পর আশা করা যায় করোনার টিকাও আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু যাঁদের জীবনের বিনিময়ে আমরা এই করোনা-যুদ্ধে এগোব, তাঁরা অনেকেই আজকের গরিব ও জীর্ণ শরীরের মানুষ। এই কারণেই এখনই ‘সুস্থ অর্থনীতি’ বনাম ‘সুস্থ শরীর’-এর তর্ক তোলা একটি নিষ্ঠুর পদক্ষেপ বলে মনে হয়।
‘সুস্থ অর্থনীতি’র অনুষঙ্গে একটি বড়ো বিতর্কও উঠে আসে। ‘সুস্থ অর্থনীতি’ বলতে কী বোঝায়? কেবল বাজারের বৃদ্ধি? এ কথা সুবিদিত যে ভারত তার জাতীয় আয়ের যতটুকু জনস্বাস্থ্য খাতে খরচ করে তা তুলনীয় দেশের তুলনায় অনেক কম। আমরা কি এই বিপদ থেকে শিক্ষা নিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাব্যবস্থা আরও মজবুত করব? গত কয়েক বছরে ভারতের গড়পড়তা মানুষের অপুষ্টি যতটা বেড়েছে, তা কমাবার জন্য কি আমরা এ বার যত্নবান হব? আর সর্বোপরি, ভাবব কি যে এই বিশ্বজোড়া বিশ্বগ্রাসী বৈষম্যমূলক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি— সামগ্রিক ভাবে তা সুস্থ কি না?

শুধু করোনা কেন, জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ বিভাগের অধ্যক্ষা সম্প্রতি বলেছেন, ইদানীং কালের মানুষের সমস্ত অসুখের শতকরা পঁচাত্তর ভাগই এসেছে জন্তুজানোয়ারের শরীর থেকে। কারণও বলেছেন। খনিজ পদার্থের খোঁজে, গাছ কেটে, জঙ্গলকে খামার বানিয়ে, মানুষের বাসস্থান বাড়িয়ে, ও বেআইনি পশু-পাচার করে, সাধারণ ভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে আমরা জন্তুজানোয়ারদের শরণার্থী বানিয়ে ছেড়েছি। আর একই সঙ্গে বিত্তবান মানুষের আমিষভক্ষণও অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে মানুষের সঙ্গে পশুপাখিদের সংযোগ ও সংঘর্ষ, দুটোই বেড়েছে। বাজারি অর্থনীতির এই সম্প্রসারণের ফলে বিশ্বপ্রকৃতির আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। হতে পারে, এই বাজারি অর্থনীতির বিকল্প মানুষের হাতে কিছু নেই আপাতত। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নানান অসুস্থতার কারণ।

তাই প্রশ্ন জাগে, একে ‘সুস্থ’ বলে বর্ণনা করলে ‘স্বাস্থ্য’ কথাটারই কি অর্থবিকৃতি করা হয় না।

ইতিহাস বিভাগ, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement